‘মেঘ আর জোয়ার দেখলেই চোখে আন্ধার দেহি’

27
Spread the love

শাহজাহান সিরাজ, কয়রা
‘প্রতি বছর বৈশাখ-জষ্টি (মে) মাস আসলি গাঙের পানি ফুঁসে ওঠে। ভয়ে বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়। মাঝ রাইতে হঠাৎ বিকট শব্দে নদের বাঁধ ভাইঙে নদীর পানি আমগো বাড়িঘরে ওঠে। কিছু বুঝবার আগেই ঘর ভাইঙা আসবাব পত্র ও হাঁস-মুরগি ভাইসা যায়। সেবারও মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমালে প্রায় ২০ দিন স্বামী-সন্তান লইয়া মানুষের বাসায় আছিলাম। আবারও ভাঙনের সময় আইয়া পড়ল; কিন্তু বাঁধ তো আর ঠিক হইল না। আকাশে মেঘ দেখলেই এহন চোখে আন্ধার দেহি।’ আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন কয়রা উপজেলার দশালিয়া গ্রামের বাসিন্দা রহিমা বেগম (৬০)।
একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্বান্ত হয়েছে এই আক্ষেপ ও দুশ্চিন্তা শুধু রহিমা বেগমের একার নয়, তাঁর মতো উপজেলার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়ীয়া নদীর ১২০ কিলোমিটার বাঁধে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক হাজার পরিবারের। একটি আঘাতের রেশ কাটতে না কাটতেই প্রকৃতির আরেকটি আঘাত। এভাবেই সবকিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব কয়রা উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার মানুষ।
ঘাটাখালি বাঁধে বসবাসকারী আমিরোন নেছা বলেন, ‘ভাঙনের ১ বছর পার অইয়া গেল, বান্দে সেই সময়ে বালির বস্তা ফেলাইয়াছিল তারপর আর মেরামত অইল না। এই ভাঙন দিয়ে ঢলের পানি ঢুইকা বিভিন্ন গ্রাম ডুইবা যায়। তখন আমাগোর বিপদ দেহার কেও আছিল না। ঋণ কইরা কুনরহম ভাঙা বাড়িঘর ঠিক করছি। আবার গাঙে বড় জোয়ার আইলে, আমাগোর কোনো উপায় থাকত না। ভাঙা বান্দের লাইগা এই এলাকার সবাই দুশ্চিন্তায় আছি।’
মঠবাড়ী পবনায় দুর্যোগে ভিটেমাটি হারিয়ে পরিবার নিয়ে বাঁধের ঢালে কুড়ে ঘরে বসে থাকা তপতি মন্ডল, এখনও ৩/৪ দিন বৃষ্টি হতে পারে শুনে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে থাকেন-
বাঁধ ভাইঙে ঘরবড়ি, জমি-জায়গা ভাসায়ে নে গেলে কী করব, ছাওয়াল-মাইয়ে নে কনে থাকব, খাবো কী? এসব চিন্তায় ঘুম আসে না, ছটফট কইরে বেড়াতি হয়।’
পরিসংখ্যানুযায়ী ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলার পর থেকে যত দুর্যোগ এসেছে তার বেশিরভাগ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ অর্থাৎ মে মাসে। এ কারণে এ সময়টিতে রহিমা বেগম ও তপতি মন্ডলের মতো বাঁধের ঢালের বাসিন্দাদের বুকের ধড়ফড় বেড়ে যায়।
আইলার পর থেকে প্রতি বছর নদীভাঙনের কবলে পড়তে হয়েছে তাদের। বেশির ভাগ মানুষ ফসলি জমি, বসতবাড়ি হারিয়েছেন। আশ্রয় নেওয়া বাঁধের জায়গা ভাঙতে ভাঙতে সরু হয়ে গেছে।
দশহালিয়া গ্রামের দীনবন্ধু মিস্ত্রি বলেন, ‘গতবার মে মাসে রেমালের ভয়ে ঘর ছাড়তি হয়েছিল। বাঁধ না ভাঙলেও উপচে পানি ঢুকেছিল। দিন-রাত সবার চেষ্টায় কোনো রকমে রক্ষে পাইছি। শুনতিছি এবার গাঙের পানি নাকি আরও বাড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো সূত্র জানিয়েছে, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার পাউবোর বেড়িবাধ রয়েছে ৬৩০ কিলোমিটার। কয়রায় ১২০. পাইকগাছায় ১৯০ ও দাকোপে ৩২০ কিলোমিটার। কয়েক বছরে সংস্কার না হওয়া-মাটি ধসে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৪৫ কিলোমিটার বাঁধ। ৯ কিলোমিটার বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়রার দুটি পোল্ডারের ৮টি স্থানে ৪ হাজার ১২০ মিটার, পাইকগাছার ৬ স্থানে ৩ হাজার ৪৪৫ মিটার ও দাকোপের ৮ স্থানে ৮৪৫ মিটার বাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাঁধ মেরামতে বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া তালিকার বাইরে নতুন নির্মাণ করা বাঁধের অনেক স্থান ধসে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে।
কয়রার ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় ১২শ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২ কিলোমিটার বাঁধ পুনঃনির্মাণের কাজ চলমান। এ প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শুরু থেকে ধীরগতিতে কাজ করে আসছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ২০ শতাংশ। এক বছর সময় বাড়ানোর পরও অগ্রগতি ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত চার মাসে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৬ শতাংশ। প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, অনেক স্থানে বালুর বস্তা ডাম্পিংয়ের কাজ চলছে। বাঁধের ওপর বালুর বস্তা স্তুপ করে রাখা হয়েছে। মুল বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর কাজে হাত দেওয়া হয়নি। ঐ সব বাঁধে পানি ছাপিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
প্রকল্প এলাকার গাতিরঘেরি গ্রামের বাসিন্দা দেবরঞ্জন বলেন, ‘দুই বছর ধইরে দেখতিছি গাঙের কুলে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। ভেড়ির (বাঁধ) ওপর এক চাপ মাটিও ফেলা হয়নি। দুর্যোগের সময় আইসে গেছে। ভয়ে আছি।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই এসব মানুষের। আইলা থেকে আম্ফান সব দুর্যোগেই ভেঙেছে উপকূল রক্ষার বেড়িবাঁধ। ভেসে গেছে মাছের ঘের, ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। নিরুপায় হয়ে বসতভিটা ছাড়ছেন অনেক উপকূলের বাসিন্দা।
উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন বলেন, ‘ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধগুলো এখন পর্যন্ত পুনঃনির্মাণ করা হয়নি। নিচু ও দুর্বল বাঁধগুলো জোয়ারের পানির চাপ সামলাতে পারছে না। ফলে তা ভেঙে বা উপচে প্রতি বছর এই সময়ে প্লাবিত হয় এলাকা। এসব বিষয় মাথায় রেখে পরিকল্পিতভাবে বাঁধ মেরামতের সঙ্গে নদীগুলোও খনন করা দরকার।’
পাউবো খুলনা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, বিভিন্ন পোল্ডারে বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ চিহ্নিত করে কাজ শুরু হয়েছে। অন্যান্য স্থানেও জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হবে। চলমান প্রকল্পের কাজে ধীরগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় মাটি ও পর্যাপ্ত বালু সরবরাহ না থাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্রুত কাজ এগিয়ে নিতে পারছেনা।