বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
করোনাভাইরাসের ভয়াল ছোবলের শিকার সারাবিশ্ব। আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা। এরই মধ্যে চলে এসেছে পবিত্র রমজান মাস। প্রতি বছরই রমজান এলে বেড়ে যায় অতিপ্রয়োজনীয় নিত্যপণের মূল্য। এ কারণে আগে থেকেই আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
অন্য বছরের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি পণ্য সংগ্রহ করে সরকারি বিক্রয়কারী সংস্থাটি। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের আমদানিকারকদের নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের এমন নানামুখী উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি গোডাউনগুলোতে নিত্যপণ্যের মজুত প্রয়োজনের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি (গত বছরের তুলনায়) এমন দাবি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। এরপরও নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের লাগাম টানা যাচ্ছে না। হু-হু করে বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এখন পর্যন্ত কয়েকটা পণ্য ছাড়া অধিকাংশ পণ্যের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। তাছাড়া সব ধরনের পণ্যের মজুত প্রয়োজনের তুলনা বেশি রয়েছে তা-ই আগামীতে আর কোনো পণ্যের দাম বড়বে না।
নিত্যপণ্যের চাহিদা ও মজুত সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরে ১৮ লাখ ৬০ হাজার টন ভোজ্যতেলের চাহিদার বিপরীতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার টন। এ সময় দেশে উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ ১৭ হাজার টন। অর্থাৎ দেশে মোট ভোজ্যতেলের মজুত রয়েছে ১৯ লাখ ১ হাজার টন। যা চাহিদার তুলনায় বেশি। গত অর্থবছরে ভোজ্যতেলের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৭ লাখ ৩০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে চিনির উৎপাদন হয়েছে ৬৮ হাজার টন। এছাড়া ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ১ হাজার টন। গত মার্চ মাসে আরও বেশকিছু চিনি আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরে বছরজুড়ে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৩৩ হাজার টন। তাই এখন পর্যন্ত চিনির আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ বছর পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি আমদানি হয়েছে এবং রমজানের জন্য পর্যাপ্ত মজুত আছে। এছাড়া স্থানীয় বাজার থেকে ভোজ্যতেল কিনে তার ওপর ভর্তুকি দিয়ে ন্যায্যমূল্যে ওই তেল বিক্রি হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার থেকে রমজান উপলক্ষে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের তেল, চিনি, ছোলা, মসুর ডাল ও পেঁয়াজ সারাদেশের ৪০০ স্থানে বিক্রি শুরু হয়েছে। প্রায় ৩৫০ ডিলারের মাধ্যমে এ বিক্রি কার্যক্রম চলছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ৩৫ লাখ টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ২৩ লাখ টন। প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। এ বছর ২৫ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া পেঁয়াজ আমদানির ওপর ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। তাই বর্তমানে প্রচুর পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। সুতরাং রমজান মাসে পেঁয়াজের কোনো ধরনের সংকট হবে না। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘রোজাকেন্দ্রিক প্রতিটি নিত্যপণ্যের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। জনগণ মনে করতে পারেন, করোনার কারণে নিত্যপণ্য আমদানিতে প্রভাব পড়েছে। কিন্তু আসলে আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই অন্যান্য বছরের তুলানায় এ বছর সব ধরনের পণ্যে মজুত প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ বেশি রয়েছে। কাজেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেন, রোজায় নিত্যপণ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। অন্যান্য বারের তুলনায় ক্ষেত্র বিশেষ প্রায় সাত থেকে দশগুণ পণ্য বেশি সংগ্রহ করে টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আটটি ভ্রাম্যমাণ মনিটরিং টিম কাজ করছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব পণ্য দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
টিসিবির পণ্য বিক্রিতে কোনো অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান মন্ত্রী। এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বলেন, এখন পর্যন্ত অধিকাংশ পণ্যের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আদার দাম কিছুটা বেড়েছে। কয়েকটি পণ্যের দাম সামান্য বেড়েছে। আশা করছি, রোজার আগে দাম আর বাড়বে না। কারণ আমাদের চাহিদার তুলনায় প্রতিটির পণ্যের মজুত বেশি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন রোজা-কে পুঁজি করে অযথা পণ্যের বাজার অস্থির করতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এছাড়া ভোক্তা অধিকার অধিদফতর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টিম নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছে। আমি নিজেও আজ (শনিবার) টিসিবির পণ্য বিক্রি ঠিকভাবে হচ্ছে কি-না, দেখার জন্য মাঠে রয়েছি। আশা করছি, এবার রোজায় পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে।’
তবে মন্ত্রী-সচিবের বক্তব্যের সঙ্গে মিল নেই বাজারের সার্বিক চিত্রের। রাজধানীর বাজারগুলো বলছে ভিন্ন কথা। পবিত্র রমজান শুরু হতে এখনও সপ্তাহখানেক বাকি। ইতোমধ্যে বেড়েছে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সাত পণ্যের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে কিছু পণ্যের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, চিকন মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল ৬২-৬৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৬-৬৪ টাকা। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা বিক্রি হচ্ছে ৫২-৬০ টাকা কেজি দরে, যা আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। স্বর্ণা, বিআর-২৮, চায়না ইরি প্রভৃতি মোটা চাল ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ইফতারের অন্যতম উপকরণ ছোলার দাম গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা মসুর ডালের দাম আরেক দফা বেড়ে ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত সপ্তাহে যা ছিল ৭৫-৮০ টাকা। ছোট দানার মসুর ডাল ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ১১২-১২০ টাকা। ভোজ্যতেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন স্থির আছে ৯৫ টাকা লিটারে, পামতেল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়।
ভরা মৌসুম সত্ত্বেও আরেক দফা বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেড়ে ৬০-৬৫ টাকায় ঠেকেছে এটি। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদার দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে চায়না আদা বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। বাজারে এখন চায়না আদা ৩০০-৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আগের সপ্তাহে যা ছিল ১৫০-১৬০ টাকা। দেশি আদা প্রতি কেজি ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগের সপ্তাহে যা ছিল ১২০-১৪০ টাকা। রসুন কেজিতে ৪০-৬০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৪০-১৬০ টাকা। গত এক সপ্তাহে নিত্যপ্রপ্রয়োজনীয় সাতটি পণ্যের দাম বেড়েছে, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ ও আসন্ন রমজান-কে কেন্দ্র করে দাম বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। দাম বেড়েছে চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও শুকনো মরিচের। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ১৭ এপ্রিল এসব পণ্যের দাম বাড়ার প্রতিবেদন তৈরি করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে আদার। পণ্যটির দাম এক সপ্তাহে শতকরা ১০৪ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে কম বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। পণ্যটির দাম বেড়েছে এক শতাংশ। এদিকে আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে টিসিবির সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ চার দফা নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। নির্দেশনাগুলোর বাইরে আরও রয়েছে- মাঠপর্যায়ে টিসিবির পণ্য বিক্রি কর্মসূচিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করা এবং দাম না বাড়ানোর বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করা। নিম্ন আয়ের মানুষকে কম দামে খাদ্যপণ্য সরবরাহের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে পরিকল্পনা চাওয়া। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘রোজায় পণ্য সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি সংক্রান্ত বৈঠক থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-কে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়।