কালীগঞ্জের পথ শিশুরা পাচ্ছে রৌদ্দুরের আলো

70
Spread the love

সাবজাল হোসেন,বিশেষ প্রতিনিধি

মামুন, কবির, নিলয়, রাব্বি, ইমন, রিয়া, সহিদুল, আফ্রিদি, তানভির, অপুসহ আরও অনেকে তারা সকলেই স্থানীয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমে তারা নানা ধরনের সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত। মুলধারা থেকে ছিটকে পড়া রেলওয়ে স্টেশনের ছিন্নমুল পরিবারের শিশুরা যারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তাদেরকে রৌদ্দুরের পাঠশালায় আলো ছড়াচ্ছেন। এতে করে শিক্ষা বঞ্চিতরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। সকল শিশুদের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থার পরিবর্তন আনতেই সংগঠনটির সদস্যদের এই নিরলস প্রচেষ্টা।

সাধারণ’রৌদ্দুর থেকে পাওয়া যায়,অন্ধকার দুর করার আলো,সাথে পাওয়া যায় ঠান্ডা রক্ষাকারী তাপও। তাপও আলোর উষ্ণতায় শিক্ষা বঞ্চিত শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে বলেই তারা তাদের সংগঠনের নাম দিয়েছেন রৌদ্দুর। শিক্ষিত যুবকেরা এমন মহৎ সেবা দিয়ে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের রেলওয়ে স্টেশনের পাঠশালাকে অধিক গতিময় করছেন। স্থানীয় একঝাক শিক্ষিত যুবকের পরিচালিত রৌদ্দুরের এমন ঝলকানিতে উপকৃত হচ্ছে প্রকৃত পিছিয়ে পড়া শিশুরা।

সরেজমিনে, কালীগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী মোবারকগঞ্জ রেলওয়েস্টেশনে গেলে দেখা যায়, স্টেশনের পাশ ঘেষে ঝুপড়ি ঘর বেধে বসবাস করছে বেশ কিছু ছিন্নমুল পরিবার। এর পাশেই বড় একটি কড়ই গাছতলায় চলছে শিশুদের পাঠশালা। যেখানে শিক্ষকেরা পাঠদান করছেন স্নেহভরা দৃষ্টিতে। আর শিশুরা পাঠ গ্রহন করছে অতি আগ্রহ আনন্দের সাথে।

সোহাগ শাকিল নামের কর্মজীবি দুই কিশোর জানায়, পরিবারের প্রয়োজনেই স্টেশনের পাশেই এক হোটেলে তাদেরকে বয়ের কাজ করা লাগে। আর বিকেল টা বাজলেই রৌদ্দুর ছড়ানোর গাছতলার স্কুলে গিয়ে ঘন্টা লেখাপড়া করি। পরে আবার এসে কাজে যোগ দিই। তারা জানায়, লেখাপড়ার পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে তাদের পাঠশালায়। এর আগে কোনদিন স্কুলে যাইনি তবে কর্মজীবি হয়েও এখন স্কুলের কিছুটা স্বাদ পাচ্ছি। শিক্ষকেরা ল্যাপটফের মাধ্যমে ছবি দেখিয়ে ক্লাস নেন ফলে আমরা শিখছি আনন্দের সাথে।     

ভ্রাম্যমান পাঠশালার শিক্ষকেরা বলেন,পথশিশুরা অধিকাংশই রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ঝুঁপড়ি ঘরে বসবাস করে। ছিন্নমুল ভাবেই তারা বেড়ে উঠে। শিশু বয়সেই তারা পেটের তাগিদে হোটেল রেস্তোরায় পানি টানার কাজ করে।  অথবা অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেয়। এভাবে তারা সারাজীবন শিক্ষার আলো বঞ্চিত থাকে। কিন্ত তাদেরও মুলধারার শিশুদের মত বেড়ে ওঠার অধিকার রয়েছে। তারা এমন ৪৫ টি ছিন্নমুল পরিরারের ওপর নিজেরা জরিপ করে দেখেছেন পরিবারগুলোর শিশুরা অবহেলা অনাদরে বেড়ে ওঠে। সে কারনেই তাদের কোন নিয়ন্ত্রন থাকে না। ফলে তারা মাদক সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে। সে জন্যই রেলওয়ে স্টেশনে পাশে তারা রৌদ্দুরের ভ্রাম্যমান পাঠশালা গড়ে তুলেছেন। তাদের সকলের ধারনা শুধু মাদক বিরোধী র‌্যালি,সভা,সমাবেশের মাধ্যমে মাদক সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব নয়। বরং মাদক সন্ত্রাসের উৎপত্তিরস্থল ধবংস করা আগে জরুরী। এটা কিভাবে সম্ভব তা নিয়েই তারা ভাবতে থাকেন। সে লক্ষ্যেই তারা নিজেদেরকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তারা এমন মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন।

রৌদ্দুরের সক্রিয় সদস্য নাহিদ হাসান জানান,তিনি ইতোমধ্যে যশোর বিসিএমসি কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন। এখন বাড়িতে থাকেন। বিকেলে কোন কাজ থাকে না। সময়টা বন্ধুরা মিলে অবহেলিতদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন মাত্র।

রৌদ্দুরের সভাপতি রেজোয়ান আহম্মেদ রাব্বি জানান, কোনদিন যাদের স্কুলে যাওয়া হয়নি তাদের নিয়ে কিছু করার ভাবনা প্রথমদিকে হাতে গোনা কিছু বন্ধুর মাথায় আসে। ভাবনা মতে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে মোবারকগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বন্ধু মিলে শুরু করেন ভ্রাম্যমান পাঠশালায় পাঠদান। প্রথম দিনেই তারা টি ছিন্নমূল শিশুর পাঠ দানের সুযোগ পান। পরে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয় বর্তমানে  রৌদ্দুরের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৫ জন। বর্তমানে রৌদ্দুরের সদস্য ৭৩ জন তাদের পাঠদান করা শিক্ষকের সংখ্যা ১৫ জন। যারা প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অর্ধশতাধিক শিশুকে পর্যায়ক্রমে পাঠদান করছেন।

তিনি আরও বলেন,তাদের পাঠশালাটি চালাতে বেশ কিছু অর্থ ব্যয় হয়। কেননা তারা প্রতিমাসে দিন শিক্ষার্থীদের খাতা, কলম,বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন। এছাড়াও তাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হয়। বছরের প্রথম দিকে তাদেরকে স্কুল ব্যাগ থেকে শুরু করে যাবতীয় শিক্ষা সামগ্রী দিয়ে থাকেন। জন্য রৌদ্দুরের প্রত্যেক সদস্য মাসে ৩০ টাকা করে চাঁদা দেন। আবার সদস্যদের কেউ কেউ সামর্থ অনুযায়ী একটু বেশি দিয়ে থাকেন। টাকা দিয়েই পাঠশালার যাবতীয় খরচ চলে।

রৌদ্দুরের সভাপতি রাব্বি আরও জানান, পাঠশালা চালাতে যারা সরাসরি পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের নিয়ে রয়েছে একটি পরিচালনা কমিটি। সঙ্গে রয়েছে একটি উপদেষ্টা পর্ষদও। সারা মাসের কর্মপন্থা মাসিক মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক হয়ে থাকে। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত এখানেও জাতীয় দিবসগুলো যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়।

সমাজ রাষ্ট্র স্বীকৃত নয় এমন কাজের সাথে যারা জড়িত তারা অধিকাংশই বিভিন্ন বস্তিতে জন্ম নিয়ে অবহেলা অনাদরে বেড়ে উঠেছে। শিশুকালে তারা লেখাপড়ার কোন সুযোগ পায়নি। পরিবারের দৈন্যতা আর অনেক ক্ষেত্রে বাবা মায়ের বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদের কারনে তারা অনাহারে অনাদরে বেড়ে ওঠে। লেখাপড়া না শিখতে পেরে কিশোর বয়স থেকে তারা জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধমুলক কর্মকান্ডে।

উপদেষ্টা রায়হান আহম্মেদ জানান, তারা মোবারকগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশের বস্তিতে খোঁজ নিয়ে জানেন অধিকাংশ শিশু পারিবারিক পরিবেশগত কারনে শিক্ষাবঞ্চিত। সে কারনেই স্টেশনের খোলা আকাশের নিচে গাছতলাতে রৌদ্দুরের আলোর ক্লাস চালাচ্ছেন।

অবহেলা আর অনাদরের শিশুদের মুলধারায় ফেরাতে পারলেই সমাজ রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকান্ড কমানো সম্ভব। কমে যাবে ভয়ঙ্কর টেররদের সংখ্যাও। এমন মত তাদের। তাদের ধারনা শিক্ষার আলো না থাকার কারনে অপ্রতিরোধ্যভাবে এমনটি হয়। আবার ছোটবেলা থেকে কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের সাথে ভিক্ষাবৃত্তির পেশা বেছে নেয়। জন্য তারা স্বাভাবিক কর্মকান্ডে আর ফিরতে পারেনা। ফলে সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা হতে তারা সমস্ত পথশিশুদের অক্ষর জ্ঞান দান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক কথায় তাদেরকে  মুলধারার সাথে ফিরিয়ে আনতে পাঠশালায় পরিশ্রম করছেন। তবে সকল শিশুদের শেখার প্রতি আগ্রহ অনেক বেশি হওয়ায় তারা শিখছে আনন্দ আন্তরিকতার সাথে।

কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ জানান, বেশ কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে বিনামুল্যে পাঠশালায় শিক্ষাদান করছে। এটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোদ্দুরের একটি দৃষ্টান্তমুলক শিক্ষনীয় কাজ। প্রতিদিন রৌদ্দুরের প্রত্যেক সদস্য তাদের টিফিনের টাকা হতে টাকা করে বাঁচিয়ে মাসে ৩০ টাকা জমিয়ে চাঁদা দিচ্ছেন। এক কথায় তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।