কেন বাড়ছে নবজাতক হত্যা?

3
Spread the love

শাহরিয়ার হাসান

রাজধানীসহ সারাদেশে চলতি মাস থেকে গত ৬ বছরে মোট ২১০টি নবজাতককে ডাস্টবিন, জঙ্গল ও রাস্তা থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ মামলা করায় অধিকাংশ নবজাতকের ময়নাতদন্তও হয়েছে। সেই ময়নাতদন্তের ওপর ভিত্তি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ডিএনএ প্রোফাইলও তৈরি করেছে। কিন্তু উন্নত দেশের মতো ডিএনএ ব্যাংক না থাকায় ডিএনএ ম্যাচ করানো সম্ভব হয়নি। আর তাই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া মৃত নবজাতকদের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী অদৃশ্যই থেকে গেছে।

প্রায়ই দেখা যায় অনাকাঙ্ক্ষিত নবজাতকের স্থান হয় ডাস্টবিন, ফুটপাত, ঝোপ-জঙ্গল, ট্রেনের বগি, শৌচাগার বা নালা-নর্দমায়। গত দুই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ৪টি নবজাতক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যার তিনটির শরীরে পচন দেখা গেছে। এমনকি কাক ঠুকরেও খেয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, চলতি মাস পর্যন্ত এ বছরে ২০টির মতো অজ্ঞাতপরিচয়ের মৃত নবজাতকের দেহ রাস্তা, ডাস্টবিন বা ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোট ২০৫টি মৃত নবজাতক উদ্ধার হয়। যার মধ্যে ২০১৯ সালে ৪২টি, ২০১৮ সালে ৩৯টি, ২০১৭ সালে ২৪টি, ২০১৬ সালে ২৮টি, ২০১৫ সালে ৫২টি মৃত নবজাতক ছিল। এদের কারোরই বাবা-মায়ের পরিচয় মেলেনি। 

সর্বশেষ শনিবার (৫ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বিপরীতে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে এক নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, নবজাতকটির শরীরে নিচের অংশ পচে গেছে। এর আগে (২৮ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে খোলা জায়গা থেকে প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা আরেকটি মৃত নবজাতক উদ্ধার করে। উদ্ধারকারী প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা জানান, নবজাতকটির গায়ে পচন ধরেছিল। সেটিকে কাক ঠুকরে খাচ্ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ঘটনাগুলো খুব অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এসব ঘটনা রোধে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে। আমরা তাদের সহযোগিতা চেয়ে থাকি। মূলত সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় এর মূল কারণ। সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করার অনুরোধ করছি।’

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন অর রশীদ বলেন, এসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলা করে। এই দুই ঘটনাতেও হয়েছে। মামলা চলতে থাকে। কিন্তু নাবজাতকের মা-বাবার পরিচয় পাওয়া যায় না। আমরা রুটিনমাফিক থানা থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠাই। মৃত্যুর কারণ জানতে ময়নাতদন্ত করতে আবেদন করি।

অপরাধ গবেষকরা বলছেন, যে কোনও জায়গায় এসব শিশুদের ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাগে, বস্তায়, কাপড়ে মুড়িয়ে। কোনও শিশুর কান্না মানুষের কাছে পৌঁছালে ভাগ্যচক্রে বেঁচে যাচ্ছে। আর এসব ঘটনায় মামলা হলেও আসামি খুঁজে পাওয়া যায় না।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, যত নবজাতক উদ্ধার হয়, সবগুলোর ময়নাতদন্ত হয় না। এ বাচ্চাগুলো সাধারণত প্রিম্যাচিউর হয়। বলতে গেলে সবগুলোই অ্যাবরশন করা। পুলিশ চাইলে আমরা ময়নাতদন্ত করি। শরীরের টিস্যু বা হাড় সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রোফাইল করে সিআইডিতে পাঠাই।

ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, নবজাতকদের সঙ্গে ডিএনএ প্রোফাইল ম্যাচ করা আমাদের দেশে অসম্ভব। কেননা আমাদের ডিএনএ ব্যাংক নেই। এটি থাকলে অনেক অপরাধই কমে যেত। উন্নত দেশে প্রত্যেক নাগরিকের ডিএনএ প্রোফাইল রয়েছে। ডিএনএ ব্যাংকে সেগুলো সংরক্ষণ করা থাকে। যেকোনও ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে তারা ডিএনএ ব্যাংক থেকে চটজলদি ম্যাচ করে ফেলে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক ল্যাব) রুমানা আক্তার বলেন, কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতকদের ডিএনএ পাওয়া গেলেও তার বাবা-মার ডিএনএ স্যাম্পল আমাদের কাছে নেই। আমাদের দেশের সব নাগরিকের ডিএনএ সংরক্ষণ না থাকায় এসব ক্ষেত্রে আমরা পরিচয় শনাক্ত করতে পারি না। তবে কোনো নবজাতকের অভিভাবকত্ব নিয়ে ঝামেলা থাকলে বা সন্দেহভাজন কেউ আটক হলে সেক্ষেত্রে ডিএনএ প্রোফাইলিং ম্যাচ করে দ্রুত সত্য উদঘাটন করা সম্ভব।

নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়েবহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এই নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জীবন্ত শিশুকে ফেলে দিয়ে যাওয়ার ঘটনাও।

ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বের সর্বোচ্চ নবজাতক মৃত্যু-কবলিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশে প্রতিবছর জন্মের পর মারা যায় ৬২ হাজার নবজাতক। এসব শিশুর মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম মাসে এবং অর্ধেকই মারা যায় ভূমিষ্ট হওয়ার দিনই। বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিণত অবস্থায় জন্ম, সংক্রমণ এবং ডেলিভারিকেন্দ্রিক জটিলতা থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি। কিন্তু এগুলো অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না। তাই এসব প্রাণহানির কারণ থেকে যায় অজানা।

– বাংলা ট্রিবিউন