বাংলাদেশে অন্যান্য অনেক অর্থকরী ফসল চাষের চেয়ে পান চাষ অনেক লাভজনক। অথচ এই খাতকে অবহেলা করা হয়েছে প্রথম থেকেই। সনাতন নিয়ম ছেড়ে আধুনিক জ্ঞানের আলোয় গবেষণাভিত্তিক পান চাষ করে ১ বিঘা জমি থেকে বছরে ২/৩ লক্ষ টাকা আয় করা যায়। কিন্তু পুরাতন পদ্ধতিতে পান চাষ করার কারণে চাষীদের গরীব থেকে আরও গরীব হওয়া ছাড়া আর কিছু থাকে না। পান চাষের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মালয়েশিয়াতে পৃথিবীর প্রথম পান চাষের সূচনা হয়। এরপরই পানের চাষ শুরু হয় ভারতবর্ষে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষকদের মাঝে বারুই শ্রেণি (পান চাষী) ছিলো সবচেয়ে বেশি ধনী। ১৮৭২ এবং ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পান উৎপাদনকারী বারুই বসবাস করত ভারতের বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলায় এবং বাংলাদেশের যশোর ও ঢাকা জেলায়। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবেই পানের ব্যবহার চলে আসছে। অনুষ্ঠানাদিতে, বিভিন্ন উৎসব, পূজা ও পুণ্যাহে পান পরিবেশন ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রাচীন কাল থেকে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা পান চাষের জন্য বেশ প্রশিদ্ধ। এ অঞ্চলের পানের চাহিদা মিটিয়ে এ পান পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভৌগলিক ও আবহাওয়া জনিত কারনে এ উপজেলা পান চাষের জন্য একটি উপযোগী স্হান। কিন্তু আশংকাজনক হারে দিন দিন পান চাষীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উপজেলার বারাকপুর, লাখোহাটি, কামারগাতি, নন্দনপ্রতাপ, আড়ুয়া, মমিনপুর সহ গাজীরহাটের প্রায় ৫০% লোক প্রত্যাক্ষ ও পরোক্ষভাবে পান চাষের সাথে জড়িতো। এ ছাড়া উপজেলার অন্য গ্রাম গুলোতে এখনও কম বেশি পান চাষ হয়ে থাকে, যা আগের চেয়ে অনেক কম।
পান চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, লেবার খরচ ও কাঁচা মাল যেমন বাঁশ, খড়, খইল, সার কীটনাশক সহ যে সকল মালামাল পান চাষের জন্য লেগে থাকে সে গুলোর মূল্য বৃদ্ধির কারনে বর্তমানে পানচাষ লাভজনক না হওয়ায় তারা পান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক পানচাষী পানচাষ ছেড়ে দিয়ে অন্য কৃষি পন্য চাষাবাস করছে। অনেকে আবার তাদের বাপ দাদার পুরাতন চাষ ছাড়তে চান না। কারন তারা বাপ দাদার আমল থেকে পান চাষ করে আসছে, ভালো উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা পানচাষ করতে চায়। কিন্তু পান চাষের খরচ বৃদ্ধির কারনে তারা দিন দিন পান চাষে উৎসাহ হারাচ্ছে। সরকারের সুদৃষ্টিই (পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋন) পারে তাদেরকে এ পেশায় রাখতে।
দিঘলিয়ার বারাকপুর গ্রামের কৃষক আবুল মতিন জানান, ভোর থেকে সকাল ১২ টা পর্যন্ত পান ভাঙতে খাওয়া দাওয়াসহ একজন শ্রমিককে খরচ দিতে হয় ৫০০ টাকা। এখন অবস্থা এমন পান ভেঙে বিক্রি করে তাতে শ্রমিকের পয়সা হয় না। পানচাষী শেখ আনসার আলী জানান, করোনার কারণে দেশের অন্য এলাকা থেকে পাইকাররা এলাকায় কম আসছেন। আবার করোনার কারণে ছোট দোকানগুলো সীমিত আকারে খোলা থাকছে। এতে করে পানের বেচাকেনা কম হচ্ছে। উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের পানচাষি সুকান্ত কুমার দাস বলেন, এক বিঘার পান বরজে (পান বাগান) বছরে পান উৎপাদনে রক্ষণাবেক্ষণ ও শ্রমিকের খরচ পড়ে আনুমানিক ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো। পানের দাম কমে যাওয়ায় এখন পান বিক্রি করে সেই টাকা উঠানো মুশকিল হচ্ছে, আর প্রাকৃতিক দূর্যোগ, রোগবালাই হলে তো আরও সমস্যা।
উপজেলার পান চাষীরা আরো জানান, তারা ভালো উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঘুরে দাড়াতে পারবে। তাঁরা স্থানীয় কৃষি দপ্তর থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পান না। গতবার প্রাকৃতিক দূর্যোগে উপজেলার অনেক পান বরজের ক্ষয়ক্ষতি হয়, স্হানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের তালিকা নিয়ে যায়, কিন্তু প্রকৃত পান চাষীরা সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাহায্যে সহযোগীতা পায়নি। এখানে পানের বাজারজাত করার ব্যাবস্হা খুবই খারাপ। স্হানীয় বারাকপুর বাজার/সন্যাসী বাজারে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পানের হাট বসে। যেখানে দুর দুরন্ত থেকে আসা পান চাষী ও পানের ব্যাপারীদের থাকা-খাওয়া, যোগাযোগ সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল। কৃষিভিত্তিক প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দিঘলিয়ায় পান চাষ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের পান বিদেশে রফতানি করে জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখা সম্ভব হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ আব্দুস সামাদ জানান, পান একটি অর্থকরী ফসল। দিঘলিয়া উপজেলায় এখনও অনেক পান চাষ হয়, এই পানের মান বেশ ভালো, এ অঞ্চলের পান বিদেশেও রপ্তানি হয়। আমরা নিয়মিত কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও চাষে উদ্ভুদ্ধ করে যাচ্ছি,। গতবছর আমরা প্রায় ১৫০ জন কৃষককে পান চাষের উপর উন্নত প্রশিক্ষন প্রদান করি। আশার বিষয় হচ্ছে দিঘলিয়া উপজেলায় নতুন করে বেশ কিছু আধুনিক পানের বরজ হয়েছে এবং বর্তমানে প্রায় ২২০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হচ্ছে। এখন করোনাকালীন দুর্যোগের কারণে পানের ছোট দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানচাষিদের ওপর একটু হলেও প্রভাব পড়েছে। তবে দুর্যোগ কাটিয়ে উঠলে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
– আসাদ, দিঘলিয়া