সুন্দরবন সংরক্ষণে ‘তুচ্ছ’ বনজীবীদের জীবন

12
Spread the love


সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস বনজীবীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বন বিভাগ। সিদ্ধান্তটি পরিবেশ রক্ষায় জরুরি হলেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হাজারো পরিবারের ওপর। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে জেলে, মৌয়াল, বাওয়াল ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট মানুষদের।
সাতক্ষীরার নদীঘেঁষা গ্রামগুলোতে এমন হাজারো পরিবার রয়েছে যাদের জীবন-জীবিকা পুরোপুরি নির্ভর করে সুন্দরবনের ওপর। কাঁকড়া, মাছ, গোলপাতা কিংবা মধু সংগ্রহ করেই চলে এসব পরিবারের জীবনযাপন। তবে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞায় তারা এখন কর্মহীন। অনেকটা ঘরবন্দি সময় কাটছে তাদের।
মুন্সিগঞ্জ এলাকার মৌয়াল শফিকুল গাজী বলেন, তিন মাস বন বন্ধ। অথচ সংসার তো থেমে নেই। সমিতির কিস্তি, তরিতরকারি, তেল, মসল্যা, ওষুধ সব কিছুরই খরচ আছে। সরকার থেকে ৫৫ কেজি চাল পেয়েছি। কিন্তু তাতে কতদিন চলা যায়? মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে চলতে হচ্ছে। একই কথা বলেন জেলে হোসেন গাজী। তিনি বলেন, একদিন মাছ না ধরলে আমাদের খাবার জোটে না। নিষেধাজ্ঞা মানি, সুন্দরবন রক্ষা দরকার। কিন্তু আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে। সেটা কি কেউ ভেবেছে? সুন্দরবনের গহীনের অপরাধীরা ঠিকই অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বনে জেলে বাওয়ালি না থাকার সুযোগে হরিণ শিকার বেড়েছে। অনেকে চুরি করে বনে যাচ্ছে।
‘একদিন মাছ না ধরলে আমাদের খাবার জোটে না। নিষেধাজ্ঞা মানি, সুন্দরবন রক্ষা দরকার। কিন্তু আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে। সেটা কি কেউ ভেবেছে? সুন্দরবনের গহীনের অপরাধীরা ঠিকই অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।’
নিষেধাজ্ঞার কারণে শুধু বনজীবীরাই নয়, বিপাকে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরাও। সুন্দরবন ঘুরতে আসা পর্যটকদের ভরসা হয়ে থাকা শত শত ট্রলার, বোট, গাইড এখন অলস পড়ে আছে ঘাটে।
ট্যুর অপারেটর জাহাঙ্গীর হোসানের বলেন, গত এক মাস ট্রলারগুলো ঘাটে পড়ে আছে। ট্রলারে প্রতিদিন স্টাফ খরচ আছে। মেরামত না করতে করতে ট্রলারগুলোর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কারণ যাত্রী না এলে আয় হয় না, আর আয় না হলে মেরামত করবো কীভাবে?
স্থানীয়রা বলছেন, যখন সাধারণ বনজীবীদের প্রবেশ বন্ধ থাকে, তখন জঙ্গলের ভেতর সক্রিয় হয়ে ওঠে চোরাকারবারিরা। বন বিভাগের নজরদারি থাকা সত্ত্বেও দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় এই সময়ে।
এ বিষয়ে এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, আমরা তো নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘরে বসে আছি। কিন্তু শুনি এই সময়েই চোরা পথ দিয়ে অনেকে গাছ কাটছে, মাছ-কাঁকড়া শিকার করছে। এদের কেউ ধরে না।
‘তিন মাস বন বন্ধ। অথচ সংসার তো থেমে নেই। সমিতির কিস্তি, তরিতরকারি, তেল, মসল্যা, ওষুধ সব কিছুরই খরচ আছে। সরকার থেকে ৫৫ কেজি চাল পেয়েছি। কিন্তু তাতে কতদিন চলা যায়? মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে চলতে হচ্ছে।’
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, সরকারি নির্দেশ মোতাবেক জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আমরা নিয়মিত টহল দিচ্ছি, স্পেশাল টিম ও স্মার্ট টিমের মাধ্যমে টহল কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বনের জীববৈচিত্র রক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা। বনজীবীদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন নিয়ম মেনে চলেন। কারও যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, প্রতিবছরই এই নিষেধাজ্ঞা আসে, কিন্তু নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান পরিকল্পনা। শুধুমাত্র ৫৫ কেজি চাল দিয়ে তিন মাস চলা যায় না।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, সরকারিভাবে প্রথম পর্যায়ে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে চাল এসেছে। সেগুলো জেলেদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়, অনেক জেলে ও বনজীবী এই তালিকার বাইরে রয়েছে।
‘সুন্দরবনকে বাঁচাতে গিয়ে যদি সুন্দরবনের মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে যায় তবে সেই সংরক্ষণ নীতিই প্রশ্নের মুখে পড়ে। তাই শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, দরকার সমন্বিত, মানবিক এবং টেকসই পরিকল্পনা; যাতে বন বাঁচে, মানুষও বাঁচে।’
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন সিডিও ইয়ুথ টিমের সভাপতি গাজী আল ইমরান জানান, সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষায় এই নিষেধাজ্ঞা জরুরি। তবে বনজীবীদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ তৈরি না করলে তারা বাধ্য হয়ে নিয়ম ভেঙে বনাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেন, ফলে প্রকৃতি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুন্দরবনকে বাঁচাতে গিয়ে যদি সুন্দরবনের মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে যায় তবে সেই সংরক্ষণ নীতিই প্রশ্নের মুখে পড়ে। তাই শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, দরকার সমন্বিত, মানবিক এবং টেকসই পরিকল্পনা; যাতে বন বাঁচে, মানুষও বাঁচে।