ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে না আসার নেপথ্যে

6
Spread the love


ঢাকা অফিস
রাজধানীর নির্মাণাধীন ভবন, ড্রেন-নালা ও অনেক খালে মশার প্রজনন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মাঝেমধ্যে নামমাত্র অভিযান চালালেও কাজের কাজ হয় না। ডেঙ্গু যখন ভয়াবহ রূপ নেয়, তখন কর্তৃপক্ষ নজরদারি বাড়ালেও এখন যেন দেখার কেউ নেই। মাঝেমধ্যে ওষুধ ছিটানো হলেও তা কাজে আসে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশক নিধনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের ঘাটতি আর সক্ষমতার অভাবে দুই যুগেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। এমন অবস্থায় পরিকল্পনামাফিক পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দেন তারা।

ডেঙ্গুর প্রকোপ ও এডিস মশা বৃদ্ধির প্রধান কারণ:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, কয়েকটি কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও এডিস মশা বৃদ্ধি পেতে পারে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে এডিস মশার প্রজনন বাড়ে। এডিস মশার ডিম ৬ মাস পর্যন্ত শুকনো স্থানে বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়া বালতি, ড্রাম, নির্মাণাধীন ভবনের চৌবাচ্চায় জমিয়ে রাখা পানি এডিস মশার বিস্তারে বড় ভূমিকা পালন করে।

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে নির্মাণাধীন ভবন:
গত কয়েক দশক ধরে রাজধানীতে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির ঝুঁকিও বাড়ছে। নির্মাণাধীন এসব ভবনে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। গত বছর রাজধানীতে ৫০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগের জন্য নির্মাণাধীন ভবনকে দায়ী করা হয়। এবারের চিত্রও আগের মতো। ডেঙ্গু মোকাবিলায় নেয়া হয়নি আগাম কোনো ব্যবস্থা।

কাজে আসছে না মশার ওষুধ:
ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য ভবন মালিকদের অসচেতনতার পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন নগরবাসী।

তারা জানান, যেখানে মশার জন্ম হয় সেখানে ওষুধ দেওয়া হয় না। মাঝেমধ্যে মশার ওষুধ প্রয়োগ করা হলেও তা কাজে আসছে না। আর ওষুধের নামে যা দেওয়া হয়, তার ভেতরে থাকে কেরোসিন।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. গোলাম সারোয়ার বলেন, সঠিক পদ্ধতিতে ওষুধ প্রয়োগ না করায় মশা মরছে না। যে দূরত্ব থেকে স্প্রে করা দরকার, এর থেকে বেশি হলে মশা বাড়বে। আর স্প্রের কারণে মশার প্রাকৃতিক শত্রুরা মারা যাবে।

মশকনিধন কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলা:
এডিস মশা নিধন বা ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। ডিএনসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৭ জন মশকনিধন কর্মীর মধ্যে মঙ্গলবার কাজ করেছেন মাত্র ৮ জন। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কর্মীই কাজে যাননি।

ডিএনসিসির ৫ নম্বর অঞ্চলের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম ওয়াসিমুল ইসলাম বলেন, মশকিনধন কর্মীদের এমন গাফিলতি আর সহ্য করা হবে না।

অর্ধেকের বেশি কর্মী অনুপস্থিত:
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড, শাহজাহান রোড, আজিজ মহল্লা, জহুরি মহল্লা, বিজলি মহল্লা, টিক্কাপাড়াসহ আশপাশের এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। এখানে মশকনিধনের কাজে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ১৭। এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব কর্মী তিনজন। বাকি ১৪ জন ঠিকাদারের মাধ্যমে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত।

এই ১৭ জনের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োজিত ৭ জন এবং সিটি কর্পোরেশনের ২ জন কর্মী মঙ্গলবার অনুপস্থিত ছিলেন। এমনকি মশকনিধনের কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাও (সুপারভাইজার) অনুপস্থিত ছিলেন। বাকি ৮ জনও নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে মশার ওষুধ নিয়ে বের হন।

ডিএনসিসির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল রুবাইয়াত ইসমত বলেন, যেসব ওয়ার্ডে মশকনিধন কর্মীরা কাজে অনুপস্থিত থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিকেলে ফগিং বন্ধ:
সাধারণত প্রতিদিন বিকেলে মশা মারতে ‘ফগিং’ (ওষুধমিশ্রিত ধোঁয়া) করা হয়। কিন্তু মঙ্গলবার উত্তর সিটির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের অস্থায়ী মশকনিধন কার্যালয় কার্যালয় তালাবদ্ধ দেখা যায়। এ বিষয়ে ঐ ওয়ার্ডের মশকনিধন কাজের তদারকি কর্মকর্তা রকিবুল ইসলাম জানান, তাদের ফগিং শুধু সপ্তাহে তিন দিন। শনি, সোম ও বৃহস্পতিবার করা হয়।

ডিএনসিসির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল রুবাইয়াত ইসমত বলেন, ফগিং কমিয়ে এনে এখন লার্ভিসাইডিংয়ে (সকালে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে ওষুধ ছিটানো) বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।

বেড়েছে কিউলেক্স মশা:
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি এলাকায় মশার উপস্থিতি নিয়ে গত মার্চ মাসে একটি জরিপ করেন গবেষকরা। ঐ গবেষণায় দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চ মাসে কিউলেক্স মশার পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ঢাকা উত্তর সিটির বিভিন্ন এলাকায়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর সিটির মধ্যে কিউলেক্স মশা সবচেয়ে বেশি উত্তরায়, এরপর দক্ষিণখানে। কিউলেক্স মশার কামড়ে গোদ ও নানা ধরনের চর্মরোগ হতে পারে।

উদ্বিগ্ন না হয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে:
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বেনজীর আহমেদ জানান, গত বছরের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সেজন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশন থেকে সতর্কতামূলক প্রচারের পাশাপাশি মাঝে মধ্যে মশা মারতে ওষুধ দিতে দেখা যায়। দুই কর্পোরেশন থেকেই বলা হচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলছেন, এডিস মশা প্রতিরোধে সবার সচেতনতাই একমাত্র উপায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জ্বর হলে বিলম্ব না করে হাসপাতালে যেতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।