যশোর অফিস
বাঁশের মাচার ওপর লকলক করছে মেটে আলুর কচি ডগা। মেটে আলুর ডগার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শীতকালীন শিম, পুঁইশাক ও মিষ্টিকুমড়ার ডগা। মাচার ফাঁকে ফাঁকে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে হলুদ ও মরিচগাছ। গোটা মাঠ যেন উদ্বেলিত সবুজের মিছিলে। কয়েক মাস আগেও এই মাচায় ঝুলছিল তরমুজ। মাটিতে ছিল গোল আলু।
কৃষিতে ফসলের এমন বৈচিত্র্েযর দেখা মেলে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের ধোপার মাঠে। শুধু ধোপার মাঠ নয়, আশপাশের মাঠগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে এমন ফসল-বৈচিত্র্য। একই জমিতে চাষ হচ্ছে গোল আলু, তরমুজ, মেটে আলু, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, শিম, পুঁইশাক, করোলা ও শসা। সাথি ফসল হিসেবে চাষ হচ্ছে হলুদ ও মরিচ।
নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের ধোপার মাঠ ও বন্দবিলা ইউনিয়নের গাইদঘাট মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাচার ওপর আছে মেটে আলু, মিষ্টিকুমড়া, শিম, পুঁইশাকের লকলকে ডগা। দুই মাচার মাঝে যে ফাঁকা জায়গা তার পাশে শয্যার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে হলুদ ও মরিচ।
কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমে জমিতে ছয় হাত চওড়া করে মাটির শয্যা (বেড) করা হয়। শয্যার ওপরে বিছিয়ে দেওয়া হয় মালচিং পেপার (একধরনের পলিথিন)। যাতায়াত ও পানিনিষ্কাশনের জন্য এক শয্যার সঙ্গে অপর শয্যার দূরত্ব রাখা হয় আড়াই হাত। এরপর বাঁশের চটায় পেরেক লাগিয়ে তৈরি করা সাত হাত চওড়া মাচা। বাঁশের খুঁটি পুঁতে এই মাচা শয্যার ওপরে স্থাপন করা হয়। মাচায় চটার ফাঁকে ফাঁকে লম্বালম্বি করে বাঁধা হয় নাইলনের সুতা। মাচার ওপরে বিছিয়ে দেওয়া হয় নাইলনের জাল। এক বিঘা জমিতে প্রথমবার মাচা করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। পরের বছর ব্যয় কমে অর্ধেক হয়। একবার মাচা করলে পাঁচ থেকে ছয় বছর চলে।
এক জমিতে বছরে চারটি মূল ফসল ও দুটি সাথি ফসল হচ্ছে। এতে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁদের নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেওয়া হয়।
সাইয়েদা নাসরিন জাহান, কৃষি কর্মকর্তা, বাঘারপাড়া তাঁরা আরও বলেন, দুইভাবে জমিতে ফসলের আবাদ করা হয়। প্রথমত, গোল আলু, তরমুজ, মেটে আলু ও মিষ্টিকুমড়া বা শসা বা বরবটি বা করলার চাষ করা হয়। সাথি ফসল করা হয় হলুদ। অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত খেতে গোল আলু রোপণ করতে হয়। ফাল্গুন মাসে গোল আলু উঠে গেলে চৈত্র মাসের প্রথমে জমি প্রস্তুত করা হয়। জমিতে শয্যা তৈরি করে তার ওপর মালচিং পেপার দিয়ে তরমুজের বীজ রোপণ করতে হয়। এ সময় শয্যার ওপরে মাচা স্থাপন করতে হয়। তরমুজের বীজ রোপণের এক মাসের মাথায় বৈশাখ মাসের শুরুতে তরমুজগাছে ফুল আসে। এ সময় খেতে মেটে আলুর বীজ রোপণ করতে হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি তরমুজ উঠে যায়। তরমুজ উঠে যাওয়ার পরপরই মিষ্টিকুমড়া বা শসা বা বরবটির (লাল) বা করলার বীজ রোপণ করতে হয়। এ সময় সাথি ফসল হলুদ লাগাতে হয়। শ্রাবণ মাসে মিষ্টিকুমড়া বা শসা বা বরবটি বা করলা উঠে যায়। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি থেকে পৌষের মাঝামাঝি সময়ে মেটে আলু উঠে যায়। আলু উঠে যাওয়ার পর খেত থেকে মাচা সরিয়ে নেওয়া হয়। দেড় থেকে দুই মাস জমি বিশ্রাম দিতে হয়।
কৃষকেরা জানান, দ্বিতীয়ত, তরমুজ, মেটে আলু, মিষ্টিকুমড়া বা শসা বা বরবটি (লাল) বা করলা ও শিম চাষ করা হয়। সাথি ফসল চাষ হচ্ছে হলুদ ও মরিচ। চৈত্র মাসের প্রথমে জমি প্রস্তুত করতে হয়। জমিতে শয্যা তৈরি করে তার ওপর মালচিং পেপার দিয়ে তরমুজের বীজ রোপণ করতে হয়। এ সময় শয্যার ওপরে মাচা স্থাপন করতে হয়। তরমুজের বীজ রোপণের এক মাসের মাথায় বৈশাখ মাসের শুরুতে তরমুজগাছে ফুল আসে। এ সময় খেতে মেটে আলুর বীজ রোপণ করতে হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি তরমুজ উঠে যায়। তরমুজ উঠে যাওয়ার পরপরই মিষ্টিকুমড়া বা শসা বা বরবটির বা করলার বীজ বা পুঁইশাকের চারা রোপণ করতে হয়। সাথি ফসল হলুদ ও মরিচ লাগাতে হয়। আষাঢ় মাস শেষে লাগাতে হয় শিমের বীজ। শ্রাবণ মাসে মিষ্টিকুমড়া বা শসা বা বরবটি উঠে যায়। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি থেকে পৌষের মাঝামাঝি সময়ে মেটে আলু উঠে যায়। শিম ওঠে পৌষ ও মাঘ মাসে। শিম উঠে গেলে খেত থেকে মাচা সরিয়ে নেওয়া হয়। জমি এক থেকে দেড় মাস বিশ্রাম দেওয়া হয়।
বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, নারিকেলবাড়িয়া ও বন্দবিলা ইউনিয়নে প্রায় ৪০ হেক্টর জমিতে বছরে চারটি ফসল ও দুটি সাথি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে।
খানপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম ৫৮ শতক জমি বন্ধকি ও ইজারা নিয়ে তিন বছর ধরে ফসল চাষাবাদ করছেন। এর মধ্যে ২৩ শতক জমিতে তিনি চারটি ফসল এবং দুটি সাথি ফসল করেছেন। খেত থেকে তাঁর তরমুজ উঠে গেছে। এখন খেতে আছে মেটে আলু, শিম ও পুঁইশাক। সাথি ফসল আছে হলুদ ও মরিচ। অবশিষ্ট ২৩ শতক জমিতে ঢ্যাঁড়স ও ১২ শতক জমিতে তাঁর লাউ রয়েছে। নজরুল ইসলাম বলেন, সব খরচ বাদে বছরে লাখ টাকার বেশি লাভ থাকে।
খানপুর গ্রামের কৃষক অনুপ কুমার দাস ৬৪ শতক জমিতে তরমুজ, মেটে আলু, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, শসা ও শিমের চাষ করেছেন। এর মধ্যে তরমুজ, বরবটি ও শসা উঠে গেছে। খেতে আছে মেটে আলু, মিষ্টিকুমড়া ও শিম। সাথি ফসল আছে হলুদ ও মরিচ।
অনুপ কুমার দাস বলেন, সব খরচ বাদে বছরে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ থাকে।
গাইদঘাট গ্রামের কৃষক অসিত বিশ্বাস এবার ৪৬ শতকে বিঘার তিন বিঘা জমিতে গোল আলু চাষ করেছিলেন। গোল আলু উঠে যাওয়ার পর তিনি দেড় বিঘা জমিতে তরমুজ, মেটে আলু, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি ও লাউয়ের চাষ করেছিলেন। তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি ও লাউ উঠে গেছে। খেতে আছে মেটে আলু। সাথি ফসল আছে হলুদ ও মরিচ। অসিত বিশ্বাস বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে জমিতে ছয়টি ফসল করছি।’
গাইদঘাট গ্রামের কৃষক শ্রীকান্ত মণ্ডল বলেন, ‘১৫ শতক জমিতে করলা ও বরবটি ছিল। ওগুলো উঠে গেছে। খেতে মেটে আলু ও লাউ আছে।’
বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইয়েদা নাসরিন জাহান বলেন, ‘এক জমিতে বছরে চারটি মূল ফসল ও দুটি সাথি ফসল হচ্ছে। এতে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁদের নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেওয়া হয়।











































