ঢাকা অফিস
নতুন দুটি টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন পাওয়ার পর ‘দলীয় বিবেচনায়’ লাইসেন্স দেওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোর বিতর্ক চলছে। বলা হচ্ছে, আগের সরকারগুলো যেভাবে ‘দলীয় বিবেচনায়’ টেলিভিশনের লাইসেন্স দিয়েছে—এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সমালোচনার মুখে এনসিপি নেতা সারজিস আলম ও প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আজাদ মজুমদারের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়েও চলছে জোর আলোচনা।
এবার যে দুই জনের নামে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে—তাদের একজন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা, অন্যজন জাতীয় নাগরিক কমিটিতে ছিলেন। তবে সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘‘সরকার যেহেতু কোনও মিডিয়া বন্ধ করছে না, ফলে ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মিডিয়া দিয়ে মন্ত্রণালয় চাচ্ছে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে।’’
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বুধবার (৮ অক্টোবর) নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিষয়টি নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘নতুন দুটি টিভি চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে গতকাল (মঙ্গলবার) প্রথম আলো রিপোর্ট করেছে। ভালো রিপোর্ট। আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে এই কারণে যে চাইলে আমরা এখন এই রিপোর্টকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করতে পারি। টিভি লাইসেন্স কারা পায়, সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই রিপোর্ট ঠিকই আছে। এই রিপোর্ট থেকেই জানা যাচ্ছে—বাংলাদেশে এর আগে ৫০টি টিভি চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে অপারেশনে আছে ৩৬টি। এই ৩৬টি চ্যানেলের মালিক কারা এটা নিয়ে অনেকের মোটামুটি ধারণা আছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এই মালিকদের নাম পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে তাদের রিপোর্টে। সৈনিক লীগের সভাপতি থেকে মুরগির ফার্মের মালিক অনেকেই লাইসেন্স পেয়েছে। সরকারি দলের সংসদ সদস্য, সংসদ সদস্যদের ভাই-ভাতিজা, ভাবি তাদের কথা তো বাদই দিলাম। আরও অনেকেই টিভি লাইসেন্স পেয়েছে মূলত রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে। আমাদের মিডিয়াগুলো এটা নিয়ে একটুও শব্দ করে নাই। হয় তাদের সদিচ্ছা ছিল না, অথবা স্বাধীনতা ছিল না। এখন তারা করতে পারছেন। তার কারণ গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করবো, গণমাধ্যম তাদের এই স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে এখন যদি কোনও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে, সেটা যেমন রিপোর্ট করবে, তেমনই স্বাধীনতার অভাবে অতীতে তারা যেসব রিপোর্ট করতে পারেনি, সেই রিপোর্টগুলোর প্রতিও আলোকপাত করবে। সংবাদমাধ্যমের এই স্বাধীনতা আমাদের সমাজের স্বচ্ছতার জন্য খুবই জরুরি।’’
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এখন দেশে ৫০টি মিডিয়া থাকলে ৪০টিতেই প্রভাব খাটাচ্ছে বিএনপি। কোনও একটা টেলিভিশনের অনুমোদন হয়েছে, আমরা যেটা জেনেছি, সেখানে এনসিপির একজন আছেন। কিন্তু একজন দিয়ে তো টেলিভিশনের অনুমোদন পাওয়া যায় না। আমরা যেটা শুনেছি, সেখানে বিএনপির লোকজনও আছেন, জামায়াতের ও স্বতন্ত্র লোকও আছেন। কেন শুধু এনসিপিকে ফোকাসড করা হচ্ছে। আমরা মনে করি, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা।’’
দিনভর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বুধবার (৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সচিবালয়ে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সঙ্গে বৈঠকে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘‘সব ক্রাইটেরিয়া ও পদ্ধতি অনুসরণ করেই নতুন মিডিয়ার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। নতুন আইন থাকলে দিতে আরও ভালো হতো, কিন্তু নতুন আইন করতে গেলে এই ব্যবস্থার ভেতরে কোনও নতুন মিডিয়া আসতে পারতো না। নতুন মিডিয়া আসলে বাজার প্রতিযোগিতামূলক হবে। একরৈখিক বয়ানের বদলে বহু স্বর, বহু মত প্রকাশ পাবে, এটিই সরকারের লক্ষ্য।’’
যদিও এই লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আমলে না নেওয়ার সমালোচনাও আবার উঠেছে। কমিশন তার রিপোর্টের সুপারিশমালায় বলেছিল, ‘‘বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর লাইসেন্সের আবেদন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র এবং লাইসেন্সধারীদের অঙ্গীকারনামা পর্যালোচনায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে এসব (বিদ্যমান টেলিভিশন) লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে কোনও উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি অনুসৃত হয়নি। এমনকি লাইসেন্স প্রাপকের কোনও পূর্ব যোগ্যতা সুনির্দিষ্ট করা ছিল না। প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনা এবং কিছুটা ব্যবসায়িক পরিচিতির ভিত্তিতেই এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সরকারের ‘বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালন নীতিমালার’ ২.৬ -এ প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স প্রদান এবং পরবর্তী সময়ে তাদের সুষ্ঠু কার্যক্রম পর্যালোচনা করে নবায়ন করার কথা বলা আছে। এ পটভূমিতে গত দেড় দশকে প্রদত্ত সব লাইসেন্স পর্যালোচনার দাবি রাখে।’’
কমিশনের সুপারিশমালায় আরও বলা হয়, ‘‘যেহেতু সম্প্রচার নীতিমালায় সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা আছে এবং সম্প্রচার লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে সুপারিশ করার দায়িত্ব সম্প্রচার কমিশনের এবং যেহেতু গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গণমাধ্যমের সব বিষয়, অর্থাৎ সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনের জন্য বিদ্যমান প্রেস কাউন্সিল ও প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশনের দায়িত্ব ও ক্ষমতার সমন্বয়ে গণমাধ্যম কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে, সেহেতু বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্সগুলো পর্যালোচনার দায়িত্ব গণমাধ্যম কমিশনই পালন করবে। ফলে গণমাধ্যম কমিশন গঠন না করে এই কাজটি করা নিয়ে আলাপ তুলেছেন অনেকে।’’
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৫০। এর মধ্যে ৩৬টি পূর্ণ সম্প্রচারে আছে। ১৪টি সম্প্রচারের অপেক্ষায় আছে।










































