খুলনা ওয়াসায় লুটপাটের মহাপ্রস্তুতি

184
Spread the love

>> পূর্বের বিতর্কিত কর্মকর্তারা যুক্ত সিন্ডিকেটে > ফের আলোচিত চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন

স্টাফ রিপোর্টার।।
বিতর্ক থামছে না খুলনা ওয়াসার। খুলনা শহরের পানি সরবরাহ এবং পয়নিষ্কনের জন্য বিগত ১/১১ সরকার আমলে খুলনা ওয়াসা যাত্রা শুরু করলেও নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতি এর পিছু ছাড়েনি। ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন সরকারি-স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও খুলনা ওয়াসার কর্তারা রয়েছেন অধরা। এরই মধ্যে নতুন করে খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রকল্পের ফেস-২ এর প্রায় ২৬ শ’ কোটি টাকার লুটপাটের জন্য চলছে মহাপ্রস্তুতি। প্রথম ফেস-এর সেই সাবেক কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
নগরীর আরও প্রায় ২৬ হাজার গ্রাহককে পানি দিতে পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেজ-২ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় ওয়াসা। এবার ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫৯৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক হাজার ৮২১ টাকা ঋণ এবং সরকার ৭৭৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেসিসি’ সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, সাবেক মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল হক, খুলনা মহানগর যুব লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান পপলু ও কেসিসি’র সাবেক প্যানেল মেয়র আমিনুল ইসলাম মুন্নার নেতৃত্বে ছিল একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। এর মধ্যে মেয়রের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তালুকদার আব্দুল খালেক খুলনা ওয়াসার চেয়াম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। বাকী সদস্যরা ছিলের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। সেই সিন্ডিকেটের সহযাত্রী ছিলেন, খুলনা ওয়াসার বর্তমান উপব্যবস্থানা পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) ঝুমুর বালা, তত্ত্বাবধয়ক প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ, সচিব/জেনারেল ম্যানেজার প্রশান্ত কুমার বিশ^াস, নির্বাহী প্রকৌশলী (১) বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের প্যানেলে আইইবি নির্বাচনে অংশ নেওয়া মো: রোজউল ইসলাম। বিগত সরকার আমলে খুলনা ওয়াসার ফেস-১ এর নানা অনিয়ম এবং নিয়োগ, পদোন্নতি এবং দুর্নীতি হয়েছে তাদের নেতেৃত্বে। অভিযোগ ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের নামে। চায়না এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠনটির কাজ পাইয়ে দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন। শেখ হেলালের হয়ে দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি (বর্তমানে আত্মগোপানে) তালুকদার আব্দুল খালেক, সাবেক মেয়র কাজী আমিনুল হক, অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান পপলু ও সাবেক প্যানেল মেয়র আমিনুল ইসলাম মুন্না। সেই চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনকে আবারও খুলনা ওয়াসার ফেস-২ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সাবেক কর্মকর্তারাই রয়েছেন মূল দায়িত্বে। ইতোমধ্যে দরপত্র/দরপ্রস্তাব উন্মুক্তকরণ কমিটি এবং দরপত্র/দরপ্রস্তাব উন্মুক্তকরণ ও মূল্যায়ন কমিটিতে সেই আলোচিত কর্মকর্তাদের নামের প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। তা পাশ হয়েছে এবং কমিটি কাজ শুরু করেছে। দুটি কমিটিতে ৯জন সদস্য রয়েছেন। তিন সদস্য বিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্ত কমিটির আহবায়ক হয়েছেন পরিচালক ঝুমুর বালা। তিনি একই সঙ্গে সাত সদস্য বিশিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহবায়ক হয়েছেন। একই ব্যক্তি দুই কমিটি থাকা মানে তার আগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরবর্তী কমিটি কোনো পরিবর্তন করা লাগবে না। তেমনি তিন সদস্য বিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটির সদস সচিব হয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ। তিনি আবার মূল্যায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। এছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রেজাউল ইসলাম দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব হয়েছেন। যদিও এধরণের বড় প্রকল্পে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ খুলনা ওয়াসাতে অনেক যোগ্য এবং দক্ষ কর্মকর্তা থাকলেও তাদের কমিটিতে রাখা হয়নি। নিজস্ব সিন্ডিকেট ধরে রাখতে একই ব্যক্তিদের দুই কমিটিতে বিশেষ কায়দায় রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রকৌশলী রেজাউল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ তথ্য নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, আমি কোনো কমিটিতে নেই, পরে ফোন কেটে দেন। অথচ গত ১৫ মে সাবেক এমডি এক পত্রে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবর পত্র প্রেরণ করেছেন এবং সেই কমিটি অনুমোদন হয়ে কাজ শুরু করেছেন বলে, খুলনা ওয়াসার সচিব স্বীকার করেছেন।
খুলনা ওয়াসার ফেস-১ এর প্রকল্পের ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হলেও খুলনাবাসী কাঙ্খিত সুফল পায়নি। এর মূল কারণ ছিল দুর্নীতি আর অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ। ফলে খুলনাবাসীকে বছরের অধিক সময়ে লবণ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই প্রকল্পের কারণে নগরীর পয়নিষ্কাষণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং সড়কগুলো আজ বেহাল অবস্থায় পড়েছে। যার মেরামত এবং সংস্কার কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ওপর।
খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেস -১ এর টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খান সেলিম আহমেদ। এবার ফেস-২ প্রকল্পের প্রস্তাবিত টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে খুলনা ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাসকে। এছাড়া প্রকল্পের দরপত্রপ্রস্তাব এবং মূল্যায়ন কমিটিতে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) ঝুমুর বালা, নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রেজাউল করিমসহ সাবেক কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে বিলুপ্ত হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের প্রতিনিধিরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তার কোনো দৃশ্যমান কাজ নেই। ফলে খুলনা ওয়াসার আওয়ামী আমলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওয়াসার নীতি নির্ধারনীসহ সকল প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে লুটপাটের মহাপ্রস্তুতি নিচ্ছেন।
খুলনা ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ^াস অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ফেস-২ প্রকল্পে ১০ টি প্যাকেজে এ কাজ সম্পন্ন হবে। দাতা সংস্থা এডিবি’র শর্ত অনুযায়ী প্রথম দফায় ৪টি প্যাকেজর কাজ চলমান। এরমধ্যে প্রকল্পের কনসালটেন্ট নিয়োগ, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ রয়েছে। তবে প্রকল্প পরিচালক পদের জন্য যে যোগ্যতা দরকার তা খুলনা ওয়াসাতে তেমন কর্মকর্তা নেই। একইভাবে কনসালটেন্ট নিয়োগ করতে হবে বাইরে থেকে। তিনি বলেন, টেকনিক্যাল পার্সনদের নিয়ে এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তার মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ করবে। নিজেকে কমিটি থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার দায়িত্ব শুধু সমন্বয় করা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন খুলনার আহবায়ক অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, প্রথম ফেস-এর কাজ এখনও শেষ হয়নি। সেখানে কর্মকর্তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সে প্রকল্প সফল না করে একই ধরনের প্রকল্প নেওয়া হলে নগরবাসীর কোনো কাজে আসবে না। বরং দুর্ভোগ আরও বাড়বে। তিনি বলেন, অতীতের দুর্নতিগুলোর তদন্ত এবং বিচার না করে নতুন প্রকল্পে আবার তাদের যুক্ত করা হলে ফলাফল একই হবে। এতে খুলনাবাসীর কোনো উপকার হবে না, তবে কতিপয় কর্মকর্তা এবং এর সঙ্গে যুক্তরা আর্থিক লাভবান হবেন। সে উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প নেওয়া হতে পারে সেটিরও তদন্ত হওয়া দরকার।