পুলিশে অস্থিরতা কাটছেই না

13
Spread the love


ঢাকা অফিস।।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগের এই সভাপতি। এর তিন দিন পর, ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে বিতর্কিত ভূমিকার জেরে এই পটপরিবর্তনকালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো পুলিশ বাহিনী; ভেঙে পড়ে শৃঙ্খলা। পুরো বাহিনীতেই ছড়িয়ে পড়ে অস্থিরতা-আতঙ্ক। এরপর পেরিয়ে গেছে ১১ মাস। দীর্ঘ এ সময়কালেও অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি পুলিশ। যদিও চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধের লাগাম টানতে সারাদেশে পুলিশের বিভিন্ন স্তরে সক্রিয়তা বেড়েছে। কিন্তু পুলিশ বাহিনী এখনও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি; পুরোপুরি হাল ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। এক ধরনের অস্বস্তি, অস্থিরতা, উদ্বেগ-আতঙ্ক এখনও অনেককেই তাড়া করে ফিরছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের তরফে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রদবদলসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অস্থিরতার অবসান ঘটছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনও উল্লেখযোগ্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা উঠলেই ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে বিষয়টি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, গত বছরের আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলকালে পুলিশের থানা, ফাঁড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়; লুট হয় আগ্নেয়াস্ত্র। এ সময় পুলিশকে কাজে ফেরানো এবং সক্রিয় করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে

পুলিশকে কাজে ফেরানো হয়। ভেঙে পড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা সচল করা হয়। এরপর সামনে আসে অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, গুলি চালিয়েছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনার কাজও চলমান আছে। এর সঙ্গে পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজও শুরু করতে হয়েছে ক্ষমতার পালাবদলের পর। উপরন্তু আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মাঠ পুলিশকে জুলাই-আগস্টের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকাজেও মনোযোগ দিতে হচ্ছে।

ক্ষমতার পালাবদলের পর পুলিশকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এরই অংশ হিসেবে রদবদলের মাধ্যমে সারাদেশে ৫০ সহস্রাধিক পুলিশের রদবদল করা হয়। এ ছাড়া পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী, ২০১৮ সালের রাতের ভোট এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩ শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ৬১ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে। আর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় ৫১ পুলিশ কর্মকর্তাকে। গত দশ দিনে পলাতক থাকা ১৮ পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জুলাই-আগস্টের মামলায় প্রায় ১৪শ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামি হওয়ার পর এই বিপুল সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের দিন কাটছে অস্থিরতায়। আবার মামলার আসামি হওয়ার ভয়ও তাড়া করছে কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে গিয়ে মাঝে মাঝেই পুলিশকে মব ভায়োলেন্সের (উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিশৃঙ্খলা) মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এসব কিছু মাথায় নিয়ে মাঠ পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য ঠিকমতো দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে মাঠ পুলিশের একটি বড় অংশই রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায় ধীরে চলো নীতি নিয়েছে।

পাথরমহালের রয়্যালিটির নামে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে ইজারাদারের দুই কর্মচারীকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা হয়। ২০০ থেকে ২৫০ জনের একটি দল থানায় ঢুকে ভাঙচুর করে সাজাপ্রাপ্ত ওই দুই আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। হামলাকারীরা থানার চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ভাঙচুর করে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র তছনছ করে। হামলায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) পুলিশের আটজন আহত হন। এর মধ্যে এক উপপরিদর্শক (এসআই) ও এক কনস্টেবল রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনা পুলিশ বাহিনীতে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক সময় এ ধরনের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট অনুষ্ঠানে ইতোমধ্যে পুলিশকে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনার পর পুলিশ সদর দপ্তরও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে আগামী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করাটাকে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, ভোট গ্রহণকালে কেন্দ্রে যদি উচ্ছৃঙ্খল জনতা বিশৃঙ্খলা করে, তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করা যাবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। এখন যেমন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাঠ পুলিশকে মাঝে মধ্যেই অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই পুলিশকে এ অবস্থা থেকে বের করে পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে তৈরি করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, গত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পুলিশ কী পারছে না, নাকি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে নাÑ এসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পুলিশের না পারার পেছনে কারণ হতে পারে জুলাই-আগস্টের ঘটনায় মনোবল ভেঙে যাওয়া, হীনমন্যতা এবং থানা থেকে অস্ত্র লুটপাট। তবে প্রায় এক বছর পর এ যুক্তি অপেশাদারত্বের শামিল। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ করছে না বলে দেখা যাচ্ছে। কারণ আইনগত শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও পুলিশকে ‘ট্যাগ’ দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আবার মাঠ পুলিশকে রক্ষা করতে ঊর্ধ্বতনদের গাফিলতি রয়েছে। একটি থানা কিংবা কোনো পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনায় অন্য সদস্যদের ওপর প্রভাব পড়ছে। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হচ্ছে সাধারণ মানুষও। আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে সরকার, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত আন্তরিকতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। পুলিশকে তার আইনানুগ দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশিত। উপরন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মব ভায়োলেন্সের নামে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়। পুলিশ সদস্যরা তাদের মনোবল অটুট রেখে পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।-আমাদের সময়