স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও উন্নত হয়নি কয়রা উপজেলা সদরের স্বাস্থ্যসেবা

6
ফাইল ফটো
Spread the love


কয়রা প্রতিনিধি
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও খুলনার কয়রা উপজেলায় একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি হাসপাতালের অভাবে লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে আমাদী ইউনিয়নের জায়গীর মহালে অবস্থিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা ৫০-১০০ কিলোমিটার দূরের খুলনা জেলা শহরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন স্থানীয়রা। সময় ও অর্থের অপচয় ছাড়াও দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অনেক মুমূর্ষু রোগী পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
কয়রা উপজেলা সদরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়ন থেকে মানুষের আনাগোনাও বেশি। অথচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি উপজেলায় একটি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকার কথা থাকলেও, কয়রার ক্ষেত্রে তা উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। এই দূরত্বই সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হওয়ার মূল কারণ। দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ জেলা শহরে গিয়ে ভালো চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
বেদকাশী-কয়রা এলাকার একমাত্র উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি দীর্ঘ আট মাস ধরে তালাবদ্ধ। ভবন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ওষুধ এবং চিকিৎসক সংকটে এটি প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পূর্বে একজন ফার্মাসিস্ট দিয়ে পরিচালিত হলেও, ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর তাকে বদলি করা হলে নতুন কেউ যোগদান করেননি। ফলে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে রোগীদের ১৭ কিলোমিটার দূরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা পাইকগাছা/খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। দুর্গম সড়কপথ ও নদীপথের কারণে অনেক সময় রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
কয়রার পাঁচটি ইউনিয়ন – বাগালী, মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, উত্তর বেদকাশী, ও দক্ষিণ বেদকাশী – ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেগুলো কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। সেখানে কোনো চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেই। ফলে এসব এলাকার বাসিন্দাদেরও দূরবর্তী হাসপাতালেই ছুটতে হয়।
কয়রার সর্বদক্ষিণের ইউনিয়ন দক্ষিণ বেদকাশী, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া এখনো লাগেনি। এখানকার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র এবং ৩১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কয়রার আমাদী ইউনিয়নের জায়গীর মহালে অবস্থিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসতে বাধ্য হন। যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে নৌকা বা ট্রলারই তাদের একমাত্র ভরসা। স্থানীয় রফিকুল ইসলাম জানান, তাদের বাড়ি থেকে কয়রা সদর ১৭ কিলোমিটার এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ কিলোমিটার দূরে। ইউনিয়নে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক থাকেন না। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে অনেক অসুস্থ মানুষ পথেই মারা যান। সম্প্রতি ৬নং কয়রা গ্রামের ঈশ্বর মালীর মেয়ে সীমা রানী বাড়িতে নরমাল ডেলিভারির পর প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে মারা যান, কারণ তাকে ২০ কিলোমিটার দূরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।
স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা সদরে একটি ২০-৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। উপকূল ও সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলন কমিটি কয়রার আহ্বায়ক এম আনোয়ার হোসেন বলেন, থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই জায়গীরমহলে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপন করা হয়, যা বর্তমানে সদর থেকে ১৭ ও দক্ষিণ বেদকাশী থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরে। এমতাবস্থায় উপজেলা সদরে একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের জোর দাবি জানান তিনি। কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের সাবেক অধ্যাপক আ.ব.ম আব্দুল মালেক জানান, উপজেলা সদরে একটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের চাওয়া, একটি প্রস্তাবনা থাকলেও সেটি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে কয়রার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো চালু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদায়ন দিয়ে উপজেলা সদরে বসার সুযোগ করে দিলে এলাকাবাসী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হতো না।
স্বাস্থ্য বিভাগ খুলনা পরিচালক ডাঃ মোঃ মনজুরুল মুরশিদ বলেন, কয়রা সদরে একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, কয়রায় ইউনিয়ন ও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক সংকটের কারণে কার্যক্রম বন্ধ আছে। মেডিকেল অফিসার সব স্থানে কম থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও দুজন-তিনজনের বেশি চিকিৎসক নেই। নতুন নিয়োগে কিছু মেডিকেল অফিসার নেওয়া হলে এই সংকট কেটে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কয়রাবাসীর দীর্ঘদিনের এই স্বাস্থ্যসেবার বঞ্চনা দ্রুত নিরসনের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের সুদৃষ্টি কামনা করছেন ভুক্তভোগীরা।