মিনি স্টেডিয়াম এখন পশু-পাখির চারণভূমি

3
Spread the love


মেহেরপুর প্রতিনিধি
মেহেরপুর সদরের আমঝুপি মিনি স্টেডিয়াম আজ যেন খেলাধুলার কেন্দ্র নয়, বরং পশু-পাখির বিচরণভূমি। তিন একর আয়তনের মাঠজুড়ে যেখানে একসময় ক্রিকেট-ফুটবলের ধুম লেগে থাকত, আজ সেখানে স্তূপ করে রাখা মাটি, ঘুরে বেড়ানো ছাগল আর জমে থাকা পানিতে খেলা করা হাঁস। মাঠের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে অর্ধসমাপ্ত গ্যালারি ছাড়া কিছুই নেই—যা দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি একটি মিনি স্টেডিয়াম। মাঠটির অবস্থান মেহেরপুর সদরের প্রায় চার কিলোমিটার পূর্বে।
মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের পাশে আমঝুপি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাছে হওয়ায় এটি ‘স্কুলের মাঠ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, একসময় মাঠটি সারা বছরই খেলোয়াড়দের পদচারণায় মুখর থাকত। একের পর এক চলত ক্রিকেট ও ফুটবলের লিগ-টুর্নামেন্ট। এ সময় চারপাশ ভরে যেত দর্শকে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ শুরু করে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। প্রথমে সেই বছরের ডিসেম্বরেই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে তিন দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ এখনো শেষ হয়নি। চলতি জুনেই চূড়ান্ত সময়সীমা ধরা হয়েছে, যদিও কাজের অগ্রগতি খুবই ধীর।
নির্মাণ শুরুর পর থেকেই নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও সাবেক ফুটবলার সাঈদ হোসেন বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে কেউ কাজ নিয়ে মুখ খোলার সাহস পায়নি। অপ্রয়োজনীয় ও মানহীন মালামাল ব্যবহার করে কাজ করা হয়েছে। এখনই টিন উড়ে যাচ্ছে, পিচ গর্ত হয়ে গেছে।’ তিনি জানিয়েছেন, মাঠের পাশে পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা (ড্রেন) হওয়ার কথা ছিল। এখন শুনছেন, নালা হবে না। তাহলে পানি কীভাবে মাঠ থেকে সরবে– এমন প্রশ্ন তোলেন।
পুরো মাঠ ঘুরেও সাঈদের কথার সত্যতা মেলে। পশ্চিম ও দক্ষিণ দুই দিকে গ্যালারির কংক্রিটের স্ট্রাকচার হয়েছে। দোতলায় প্যাভিলিয়নের পাশে কিছু চেয়ার বসানো হয়েছে। আর কোথাও চেয়ার বসেনি। অন্যান্য কাজও হয়নি। মাঠ, ড্রেন, মাঠের পাশের রাস্তা সবকিছুই অগোছালো পড়ে আছে।
একসময় এই মাঠেই অনুশীলন করত ইমরুল কায়েস ক্রিকেট একাডেমির শিক্ষার্থীরা। এখন আর তা সম্ভব হয় না বলে জানায় একাডেমির অনূর্ধ্ব-১৬ দলের ক্রিকেটার সায়েম ইসলাম। আমঝুপির এই কিশোর সদস্য এসএসসি পাস করেছে। ক্রিকেট ঘিরেও তার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ফিকে হতে বসেছে নিয়মিত মাঠে প্র্যাকটিস করতে না পারায়। সায়েমের ভাষ্য, ‘কোচের সঙ্গে শুধু ইনডোর প্র্যাকটিসটা করতে পারি। এই মাঠে খেলে অনেক ক্রিকেটার বিভাগীয় পর্যায় ছাড়াও ঢাকায় খেলেছেন। দুই বছর মাঠে বন্ধ থাকায় আমাদের ভালো প্র্যাকটিস হয়নি।’
এ একাডেমির কোচ আসাদুজ্জামান লিটন জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে মাটি এনে ওই মাঠে তারা পিচ তৈরি করেছিলেন। এতে খরচ হয়েছিল ৩ লাখ টাকা। সেই পিচ এখন গর্ত। বর্ষায় পানি জমে। হাঁস খেলা করে। বারবার কাজের মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ হচ্ছে না। এখন মাঠের ভেতর মাটি ফেলে রেখেছে। দুই বছর ধরে ছেলেরা প্র্যাকটিস করতে পারছে না। তাই ইনডোর অনুশীলন করেই খেলতে যায়। জেলা দলের হয়ে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না তারা।
আমঝুপি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জাহির হোসেন চঞ্চলের অভিযোগ, স্টেডিয়ামটি নির্মাণে বরাদ্দের টাকা হরিলুট হয়েছে। ঠিকাদারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী মিলে কোনো রকমে একটা স্ট্রাকচার খাড়া করে টাকা আত্মসাৎ করেছে। এখন শিডিউল অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। তাই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও টাকা ছাড় দিচ্ছে না। ফলে কাজে কোনো গতি নেই। এলাকার খেলোয়াড়রা বঞ্চিত হচ্ছে।
নিজ নামের একাডেমির তদারক করেন জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার ইমরুল কায়েস। তাঁর ভাষ্য, খেলাধুলা হলো প্র্যাকটিসের বিষয়। খেলোয়াড়রা যত বেশি প্র্যাকটিস করতে পারবে তত বেশি ভালো খেলোয়াড় হয়ে উঠবে। মাঠ না থাকায় আমার একাডেমির অনেক ভালো খেলোয়াড়ের প্র্যাকটিস বন্ধ। কোচ কোনো রকমে ইনডোর প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। এটি ভালো খেলা ও নিজেদের মেলে ধরার জন্য যথেষ্ট নয়। দ্রুত মাঠটির কাজ শেষ করে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ৫ আগস্টের পর থেকেই তারা লাপাত্তা বলে জানান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রকৌশলী সাদ্দাম হোসেন। তিনিই এখন মাঠের কাজ দেখভাল করছেন। এই প্রকৌশলী বলেন, নানা জটিলতায় মাঠের কাজ শেষ হয়নি। ঠিকাদারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ করে রাখতে হয়েছিল। এখন বাকি কাজ আস্তে আস্তে করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ করা কষ্টসাধ্য। তারপরেও শেষ করার চেষ্টা চলছে। এ জন্য পারিপার্শ্বিক সহায়তা চান তিনি।
মেহেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সিদ্ধান্তে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসক ওই স্টেডিয়ামের কাজ বুঝে নিতে জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা ও ইউএনওকে দায়িত্ব দেন। তিনি তিনবার কাজ দেখে এসেছেন। এখন মাটি ভরাট ও রঙের কাজ চলছে। কাজ ধীরগতিতে হলেও চলছে। ঠিকাদার মনোনীত প্রকৌশলীকে কাজ দ্রুত শেষ করতে তাগাদা দিচ্ছেন। তবে মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।