কয়রা প্রতিনিধি
সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল বনজদ্রব্য আহরণের পাশাপাশি ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে বন্ধ থাকবে পর্যটক ও সাধারণ সাধারণ মানুষের প্রবেশও।
সূত্র প্রথম আলো
তবে বাস্তবে এর উল্টো চিত্রের দেখা মিলেছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেখানে অবাধেই চলছে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনার কয়রা উপজেলায় ‘কম্পানি’ নামধারী কিছু অসাধু মাছ ব্যবসায়ীর ইন্ধনে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে ও বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। গহিন বনের নীল কোমল স্টেশনের আওতাধীন বালুরগাং, আমড়া তুলি, নীল কোমল অফিস খাল, বঙ্গবন্ধু, পুনতি দ্বীপ, কেঁড়ড়াসুটি, ভোমরখালীর আওতাধীন বয়ার শিং, ভোমর খালি অফিস খাল, পাটকোস্টার আওতাধীন মোরগখালী, চেরাগাখি, পাটকোস্টা অফিস খাল, কাশিয়াবাদের আওতাথীন নলবুনিয়া, বজবজা, খাসিটানা ছোটো দুখমুখি, বড় দুধমুখি, পিনখালি, চালকি, কালাবগির আওতাধীন আদাচাই, অফিস খাল, মামার খাল, গেওয়াখালী, ভোমরখালী, পাথকষ্টাসহ অন্যান্য খাল ও ভারানিতে ২০০-২৫০টি নৌকায় চিংড়িসহ অন্য প্রজাতির মাছ শিকার করছে তারা। তাদের এ কাজে বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
অবৈধভাবে মাছ আহরণের পর জেলেরা তাদের আহরণকৃত চিংড়ি ভোরে কয়রা উপজেলা মৎস্য আড়ত, চাঁদালি মৎস্য আড়ত, পার্শ্ববর্তী শ্যামনাগরে নওয়াবেকীর মৎস্য আড়ত, প্রতাপনগর মৎস্য আড়ত, নলিয়ান, দাকোপ ও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মংলায় নিয়ে বিক্রি করছে।
শুঁটকির ফড়িয়ারা গোপনে এসব চিংড়ি জেলেদের কাছ থেকে কম দামে কিনে সুন্দরবনের সন্নিকটে পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কয়েকটি খটিঘরে নিয়ে আগুনে শুকিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছে।
পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের বানিয়াাখালী, নীলকোমল, নলিয়ান, কাশিয়াবাদ, কোবাদাক স্টেশনের ও টহল ফাড়ির কিছু অসাধু বনরক্ষীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব মৎস্য আহরণ চলছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের বাইরে কোনো জেলে মাছ ধরতে সুন্দরবনে গেলে তাদের বন কর্মকর্তা ও পুলিশ দিয়ে মাছসহ ধরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময়ে বনের ভিতর প্রবেশ করে মাছ ধরার কোনো সুযোগ নেই। তারা নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে অবৈধ কিছু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা প্রতিদিন নৌকা প্রতি ১০ টাকা করে দিয়ে বন বিভাগকে ম্যানেজ করে বন্ধের সময়ও মাছ ধরা অব্যাহত রেখেছে। এই সিন্ডিকেটের মধ্যে বন বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমান কর্মকর্তা, সাংবাদিক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বনদস্যুদের পৃষ্টপোষক হিসেবে পরিচিত এবং একাধিক মামলার আসামিরা রয়েছেন। বর্তমানে সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোনো সাধারণ জেলে-বাওয়ালি বনে প্রবেশ করতে না পারলেও কম্পানি নামধারী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট মাধ্যমে বন বিভাগকে ম্যানেজ করে তাদের অবৈধ ব্যবসা চালু রেখেছেন।
এ দিকে সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে লোক দেখানো বলে উল্লেখ করেছেন সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলেরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জেলে বলেন, যে কারণে সুন্দরবনের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় সেই কাজ শতভাগ হয় না, হয় লোক দেখানো কিছু। তারা বলেন, নিষেধাজ্ঞাটা গোটা সুন্দরবনে। এ কারণে বনের ভেতরের নদী-খালে সাধারণ জেলেরা যেতে পারেন না। কিন্তু যারা গভীর সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে মাছ ধরেন, তাদের কিন্তু এ সময়টা সুবর্ণ সুযোগ। কারণ তখন সাধারণ জেলেরা থাকে না।
সুন্দরবনের আয়তনের শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি এখন অভয়ারণ্যভুক্ত উল্লেখ করে তারা বলেন, সাধারণ সময়েই ওদের আটকানো যায় না, আর এখন তো নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞার সময়ে সুন্দরবন ইজারা নেওয়ার মতো করে তারা অভয়ারণ্য দখল করে নেয়।
বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও কিছু জেলে ও কম্পানীরা জানান, ঘুষ দিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান তারা। একজন বলেন, সব ম্যানেজ করেই সুন্দরবনে যাই। মহাজন আর আড়তদার ম্যানেজ করে দেয়। অভয়ারণ্যে তো বারো মাস বন্ধ আমরা ম্যানেজ করে সেখানেও ১২ মাস মাছ ধরি। তবে বন্ধের সময় একটু বেশি টাকা দিতে হয়।
আবার অনেক জেলে জানান, নিয়ম মানলে তো আর পেট চলে না। নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারের খাদ্য সহায়তা সব জেলে পায় না। যাদের নাম তালিকায় আছে, তারাও সময়মতো সহায়তা পায় না। তাদের অভিযোগ, প্রকৃত জেলে না হয়েও অনেক সচ্ছল মানুষ এই সহায়তা পান।
কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশির জেলে মোকসেদ আলী বলেন, আমরা সুন্দরবনের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। আমরা সারা বছর যা রোজগার করি বন্ধের সময় তাতে ভালোভাবে সংসার চলতো। কিন্তু কম্পানি নামধারী সিন্ডিকেটের কারণে আমরা অভাব কাটিয়ে উঠতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, তারা প্রভাবশালী, তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছাড়া সুন্দরবনের মাছ-কাঁকড়া ধরা যায় না। বিভিন্ন সময় মামলা খাওয়ার ভয়ে কষ্ট হলেও মুখ বুঝে সহ্য করি। তাদের হাত অনেক লম্বা, তারা সবাইকে ভাগা দিয়ে সকল জেলেকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এ দিকে বন বিভাগ সূত্র জানা যায়, পাস-পারমিট বন্ধকালীন তিন মাস অবৈধভাবে বনে ঢুকে কেউ যাতে মাছের বংশবিস্তারে ক্ষতিসাধন না করতে পারে, সে দিকে সকলকে সজাগ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে স্টেশন কর্মকর্তাদের।
নিষেধাজ্ঞার সময়ে বন থেকে মাছ-কাকড়া আহরণের বিষয়ে সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীন বলেন, এভাবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা অব্যাহত থাকলে সুন্দরবনের জলজ সম্পদসহ জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। প্রশ্ন হল, যারা অবৈধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে তারা কীভাবে ঢুকছে এবং আহরণকৃত মাছ-কাঁকড়া কোথায় বিক্রি করছে? বন বিভাগের সে বিষয়ে কোনো কার্যকর মনিটরিং নেই। নিষেধাজ্ঞার সময়ে সুন্দরবনের কিছু অসাধু বন কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে এর সুফল পাওয়া যায় না। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞার সময়ে সুন্দরবন উপকূলীয় জেলেদের পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
তবে নিষেধাজ্ঞার সময়ে সুন্দরবনে অবৈধভাবে মাছ ধরার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবে করেছেন খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুজ্জামান। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা মধ্যে সুন্দরবনে প্রবেশ করে মাছ ও কাঁকড়া ধরার কোন সুযোগ নেই। নিয়মিত টহল অভিযান অব্যাহত আছে। আমিও কাউকে না জানিয়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে নিয়মিত টহল কার্যক্রম মনিটরিং করছি। তারপরও যদি কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।