গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রত্যাশায় খুলনাবাসী

8
Spread the love

স্টাফ রিপোর্টার।।

বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে-এই প্রশ্নটি এখন শুধু বন্দরনগরী খুলনায় নয়, দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মাঝে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ খুঁজতে হবে। খুলনার রাজনৈতিকভাবে সচেতন নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, তরুণ, এমনকি দিনমজুর পর্যন্ত এই প্রশ্নে উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবাহ এবং জনআস্থার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গতকাল খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে চায়ের স্টলগুলোতে এটিই ছিল আলোচনার মূল বিষয়। এর আগে শনিবার (১৭ মে) খুলনায় অনুষ্ঠিত হয় তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা’র লক্ষ্য সামনে রেখে ‘তারুণ্যের মহাসমাবেশ। খুলনার ঐতিহাসিক সার্কিট হাউজ মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ সমাবেশ। এ সামাবেশে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের নেতাকর্মীসহ আম-জনতা যোগদেয়। ফলে শনিবার খুলনায় জনস্রোতের সৃষ্টি হয়। সার্কিট হাউজ মাঠ থেকে শুরু করে কিলোমিটারের মধ্যে পা ফেলার জো ছিল না। যা রবিবার বিকালেও বাস, পরিবহন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে মানুষের ফিরতি যাত্রা লক্ষ্য করা গেছে। শনিবারের সমাবেশে প্রধান অতিথি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, বিচার ও সংস্কারের নামে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা সম্মানজনক হবে না। এ দেশের মানুষ সেটি মেনে নেবে না। এই সরকারের একমাত্র ম্যান্ডেট স্বচ্ছ নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিলাম, নির্বাচনমুখী জরুরি সংস্কার করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। আপনি সেটি গ্রহণ করেছিলেন। আবার সেখান থেকে সরে গেছেন। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, কিন্তু মনে করবেন না রোজ কিয়ামত পর্যন্ত আপনাদেরকে আমরা এই জায়গায় দেখতে চাইবো। ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আপনার সরকারকে লোকজন বলছে এনসিপি মার্কা সরকার। আপনার সরকারে এনসিপির দুই জন প্রতিনিধি বিদ্যমান। তারা উপদেষ্টা এবং এনসিপি সংগঠন করে। আপনি যদি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চান, তাহলে এনসিপি মার্কা দুইজনকে পদত্যাগ করতে বলুন। পদত্যাগ না করলে আপনি বিদায় করুন। আপনার কেবিনেটে আরও কিছু উপদেষ্টা আছে, তারা ফ্যাসিস্টদের দোসর এবং কিছু এনজিও প্রতিনিধি আছে, তারা দেশে নির্বাচন দিতে চায় না। তাদেরকে পদত্যাগ করতে বলুন। অন্যথায় আপনি তাদের বিদায় করুন। আপনার দায়িত্ব শুধুমাত্র নিরপেক্ষ, সুষ্ঠ নির্বাচন করে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু এখন দেখছি আপনি কথিত মানবিক করিডোর দিতে চাচ্ছেন। দেশের নৌ ও স্থল বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন। অথচ এই ম্যান্ডেট এদেশের জনগণ আপনাকে দেয়নি। আপনি জাতির স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলেন না এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করলেন না। প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, আপনার সরকারে একজন বিদেশি নাগরিককে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেছেন। আপনার কি সেই আক্কেল জ্ঞান নেই। একজন বিদেশি নাগরিকের কাছে এই দেশের সেনাবাহিনী কিভাবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রদান করবে। সেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে বিদায় করুন। একজন বিদেশি নাগরিকের হাতে জাতীয় নিরাপত্তা কতোটুকু নিরাপদ থাকবে সেটি এখন বড় প্রশ্ন। ওই উপদেষ্টা ইতোমধ্যে বলেছেন, কে কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি আরও বলেন, এদেশের মানুষ যদি নির্বাচনের জন্য যমুনা অভিমুখে লং মার্চ করে, সেটি হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। এদেশের জনগণ নির্বাচনের জন্য যমুনা অভিমুখে লং মার্চ করুক, সেটি কাম্য নয়। আমরা সব সময়ই বলেছি নির্বাচন ও সংস্কার কাজ এক সঙ্গে চলবে।

খুলনাবাসী মনে করে শনিবারের সমাবেশে তাদের দাবির প্রতিফলন হয়েছে। খুলনার নাগরিকদের অন্যতম প্রধান দাবির মধ্যে রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনকালীন রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান। তাদের মতে, নির্বাচনকালীন সময়ের প্রশাসনিক কাঠামো, ভোটের দিনক্ষণ, রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা—এইসব বিষয়ে জনগণকে স্বচ্ছ বার্তা দিতে না পারলে অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হবে।তারা আরো বলে, নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া এই অস্থিরতা কাটবে না। মানুষ জানে না আগামীতে কি হবে, এমন অবস্থায় স্বাভাবিক জীবনযাপনও দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে নিরপেক্ষভাবে সব পক্ষকে যুক্ত করে একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করা এবং সেই মতে নির্বাচনের আয়োজন করা। খুলনার মানুষ অতীত নির্বাচনগুলোর (বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪) অভিজ্ঞতা থেকে হতাশ। অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে এসব নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি তারা। “রাতের ভোট”, “গায়েবী ব্যালট” এবং ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব—এসব অভিযোগ গণমাধ্যমেও ব্যাপকভাবে এসেছে। ফলে, আগামীর নির্বাচন নিয়ে জনগণ যেমন প্রত্যাশিত, তেমনই সন্দিহানও বটে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. কুদরত-ই খুদা বলেন, ভোটের দিন ভোট দিতে পারবো-এই আত্মবিশ্বাস যদি ফিরে না আসে একই সাথে যোগ্য প্রার্থী যদি না হয়, তাহলে নির্বাচন মানেই হবে প্রহসন।

মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাড. শফিকুল আলম মনা বলেন, একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অবিলম্বে একটি নির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য রোডম্যাপ জরুরি। এটি শুধু নির্বাচনের দিন ঘোষণা নয় বরং একটি আস্থা পুনঃস্থাপনের প্রক্রিয়া। খুলনার জনগণের মতো সারাদেশ এখন অপেক্ষা করছে-একটি আস্থার পরিবেশ, একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এবং শেষ পর্যন্ত একটি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের।

মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন জানান, তারুণ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনা ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ দেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির এক যুগান্তকারী কর্মসূচি ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই আয়োজন একটি মাইলফলক। এই কর্মসূচি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অভিনব নেতৃত্ব এবং নির্দেশনার উজ্জ্বল স্মারক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সময়কাল এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে স্থানীয় বিনিয়োগ থেমে আছে, ব্যাংক ঋণ বিতরণে আগ্রহ নেই, রপ্তানি আদেশে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তরুণ সমাজ কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে জনমনে ভর করেছে অনাস্থা। ফলে নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই এবং তা হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরোপেক্ষ।

খুলনা মহানগর বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক মিজানুর রহমান মিলটন বলেন, বিগত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা, এবং গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার জন্য এক অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ের সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে লড়াই করা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়। এরই মধ্যে ১৭ তারিখের সমাবেশ দেশের তরুণ সমাজের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় সূচনা করেছে। আমাদের দেশের জনগণের বৃহৎ অংশই তরুণ এবং তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট, তারা দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাদের মেধা, জ্ঞান, এবং স্বপ্ন-এর সদ্ব্যবহার করা আমাদের মূল লক্ষ্য। এটি শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয় বরং একটি জীবন্ত বাস্তবতা, যা আমাদের তরুণ সমাজের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রগতি এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করার পথে নিয়ে যাবে।

যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পারভেজ মল্লিক বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এখন কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও একটি অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন দেখতে চায়। খুলনার মানুষ মনে করে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়-এটি একটি সম্মিলিত জাতীয় চুক্তি হওয়া উচিত, যেখানে সব রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত থাকবে। -ইনকিলাব