নির্বিচারে সাব-মার্সিবল, গভীর নলকূপের ব্যবহার # দৈনিক ২০ কোটি ৯৭ লাখ ৪ হাজার লিটার পানি উত্তোলন # দৈনিক ১১ কোটি ১০ লাখ লিটার পানি উত্তোলন স্তর নামবে ১৪ মিটার
বিশেষ প্রতিনিধি
নাগরিকদের পানি চাহিদা মেটাতে মহানগীর খুলনায় ভূগর্ভস্থ থেকে নির্বিচারে পানি উত্তোলনে ভবিষ্যত হুমকিতে পড়ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। প্রায় ১৫ লাখ মানুষের এই নগরীতে প্রয়োজনীয় দু’লক্ষাধিক ঘনমিটার পানির অর্ধেকের বেশী ভূগর্ভস্থ। ফলে খুলনায় দিন দিন পানির স্তর যেমন নিচে নেমে যাচ্ছে, তেমনি পানিতে লবণাক্ততা, আর্সেনিকসহ ক্ষতিকারক উপাদান বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে ও যথেচ্ছা ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার, হাজার হাজার উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সাব-মার্সিবল স্থাপন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রিভার্স অসমোসিস স্থাপন ও ভূ-উপরিস্থিত পানির ব্যবহার কম হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কালের কণ্ঠের নিজস্ব অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ভূগর্ভস্থ পানির উপর অতিনির্ভরতা শহরটিকে একটি নীরব সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। ভূ-গর্ভস্থ পানির বর্তমান অবস্থা ও দৈনিক উত্তোলন নিয়ে কোন তথ্য না থাকায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।
খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য কারিগরী সহায়তা পরামর্শ প্রতিবেদন প্রণয়ন করে এশিয়ান ডেপেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। পরামর্শ প্রতিবেদনের জন্য এডিবি খুলনার আশপাশের ৯৯৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ পানির উৎস নির্ধারণের জন্য ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) যৌথভাবে গবেষণা করে। ২০২৪ সালের অক্টোবর খুলনা ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে এ প্রতিবেদন দাখিল করে দাতা সংস্থাটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) এলাকায় তিনটি ভূগর্ভস্থ স্তর বা জলাধার (অ্যাকুফেয়ার) রয়েছে, এরমধ্যে ২৫০ মিটারের নিচে একটি বিশুদ্ধ পানির স্তর পাওয়া গেছে। যা প্রায় ৯৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত। একটি পুরুমাটির স্তর গভীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে উপরের লবণাক্ত পানির স্তর থেকে রক্ষা করছে। এটি ভূগর্ভস্থ পানির উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য ব্যবহারযোগ্য। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তর ব্যবহারযোগ্য নয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় স্তর লবণাক্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে খুলনা ওয়াসা পরিচালিত গভীর নলকূপ, হ্যান্ড টিউবওয়েল, বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক নলকূপসহ বিভিন্ন উৎস থেকে দৈনিক মোট ২০ কোটি ৯৭ লাখ ৪ হাজার লিটার পানি উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ ৫৯ হাজার লিটার পানি অগভীর স্তর থেকে ও ১০ কোটি ৬৪ লাখ ৪৫ হাজার লিটার পানি গভীর স্তর থেকে উত্তোলিত হয়। গণিতভিত্তিক মডেল অনুযায়ী, প্রতিদিন ২ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার লিটার পানি উত্তোলন করা হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় ৪ মিটার কমবে ও চার বছরের মধ্যে এটি স্থিতিশীল হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ২০০৪-২০০৯ সময়কালে পর্যবেক্ষণ নলকূপগুলোর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিয়ে গবেষণা অনুযায়ী, খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দৈনিক ১১ কোটি ১০ লাখ লিটার পানি উত্তোলন করা হলে পানির স্তর ১৪ মিটার পর্যন্ত নেমে যাবে। যা পুনরুদ্ধারের জন্য, প্রতিদিন কমপক্ষে চার ঘণ্টা সকল নলকূপ বন্ধ রাখা প্রয়োজন। যা এডিবির ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পানি প্রকল্পের সম্ভাবতা নিয়ে ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যদি কর্তৃপক্ষ সম্মতি দেয়, তবে গভীর স্তর থেকে অতিরিক্ত ৫ কোটি ৯০ লাখ লিটার পানি উত্তোলন করা যেতে পারে, যা বর্তমান গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৬ মিটার থেকে আরও ৪ মিটার কমিয়ে আনবে। তবে ওয়াসার উচিত নিয়মিত পরিমাপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ও গুণগত মান পর্যবেক্ষণ করা ও উৎপাদন নলকূপগুলোর পুনর্জীবন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা।
গবেষষায় বর্তমান প্রায় ১৫ লাখ মানুষের জনসংখ্যার মহানগরী খুলনা ২০৩০ সালে ২৯ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মন্তব্য করা হয়। ফলে নগরবাসীর পানির চাহিদাও দ্বিগুন বাড়বে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতি নির্ভরশীলতা এ অবস্থায় খুলনায় বিপর্যয়ে ফেলবে।
‘অ্যাসেসমেন্ট অব গ্রাউণ্ড ওয়াটার কোয়ালিটি ইন খুলনা সিটি অফ বাংলাদেশ ইন টার্মস অব ওয়াটার কোয়ালিটি ইনডেস্ক ফর ড্রিকিং পারপাস’ শীর্ষক গবেষণায় নগরীর এক তৃতীয়াংশ পানির মানসম্মত হলে ধারণা দেওয়া হয়েছে। নগরীর ভুগর্ভস্থ পানির গুনগত মান নিয়ে ২০২০ সালে করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জগদীশ চন্দ্র জোয়াদ্দার, আসিফ মাহমুদ ও শ্রাবণী শিকদার। বর্ষা-পূর্ব সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৯ টি নলকূপের পানির নমুনা নিয়ে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, নগরীর ভূগর্ভস্থ পানির মধ্যে ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ খুব ভাল, ৫৪ দশমিক ২৪ শতাংশ ভাল, ২৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ খারাপ ও ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল খুব খারাপ মানের। এসব টিউবওয়েলের গভীরতা ছিল ১৫০ মিটার থেকে ১ হাজার ১৬০ মিটার পর্যন্ত। যার গড় গভীরতার ৭৭৫ মিটার। বর্ষা ও বর্ষা পূর্ব সময়ে পানির বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা, দ্রবীভুত কঠিন পদার্থ. দ্রবীভূত অক্সিজেন, নাইট্রেট, ক্লোরাইড গণনা করা মানগুলি ৪০.১১ থেকে ৪৫৪.৩৭ পর্যন্ত ছিল, যার গড় মান ১০৮.৯৪। ফলাফল বিশ্লেষণে বলা হয়েছে খুলনা শহরের বেশিরভাগ এলাকার ভূগর্ভস্থ জলের গুণমান কিছু এলাকায় উচ্চতর বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা ও ক্লোরাইডের পরিমাণ বাদ দিলে পানীয়জলের জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত বলে জানানো হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত খুলনা ধীরে ধীরে বঙ্গোপসাগরের তলদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যা ভূগর্ভস্থ জলে লবণের ঘনত্বের উৎস হতে পারে বলে মতামত প্রদান করা হয়।
২০১৭ সালে জেআইজেড এর সহযোগীতায় নগরীর ভূগর্ভস্থ আর্সেসিকের অবস্থা বিশ্লেষণ করেন উন্নয়নকর্মী শামীম আরফীন ও হেলেনা খাতুন। তারা খুলনা নগরের বিভিন্ন প্রান্তের ২৩টি নলকূপের মধ্যে প্রায় সবকটিতেই আর্সেনিক সনাক্ত করেন। যারমধ্যে ৫টিতে মাত্রা ছিল দশমিক ১। যারমধ্যে ৩১ ও ২২ ওয়ার্ডে আর্সেনিক উপস্থিতি বেশী ছিল।
খুলনা ওয়াসা ও খুলনা সিটি করপোরেশনের পৃথক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মহানগরীতে হোল্ডিং সংখ্যা ৭৬ হাজার ৬২৮টি। অপরদিকে ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা ৪৩ হাজার ১০০ জনের বেশী। ফলে হোল্ডিং সংখ্যার চেয়ে ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা ৩০ হাজার ৫০০জন কম। যাদের একমাত্র ভরসা ভূগর্ভস্থ পানি। আবার ওয়াসার গ্রাহকের সিংহভাগই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে গভীর নলকূপ ও সাব-মার্সিবল ব্যবহার করছেন। কম হলেও মহানগরীতে ৪০ হাজারেরও বেশী সাব মার্সিবল ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে একাধিক বেসরকারি বাণিজ্যিক পানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যারা রিভার্স অসমোসিস (আরও) পদ্ধতিতে বোতলজাত পানি বিক্রি করে। এপদ্ধতিতে উত্তোলিত পানির মাত্র ৩০ শতাংশের মতো ব্যবহৃত হয়। অথচ ওয়াসার আইন অনুযায়ী নলকূপ স্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ পর্যন্ত নিবন্ধনেরর সংখ্যা মাত্র এক হাজার ৮০০টি। এমন অবস্থায় বর্তমানে পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার ১১ কোটি লিটার সক্ষমতার মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে মধুমতি নদী থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছে। এছাড়া ৭১টি স্থানে ১১১টি বিভিন্ন আকারের নলকূপ পরিচালনা করে গ্রাহকের পানি সরবরাহ করছে।
তবে জলবায়ূ পরির্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মহানগরী খুলনার ভূগর্ভ থেকে কী পরিমান পানি উত্তোলন হচ্ছে তার কোন নিদিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।
খুলনা উপকূলীয় পানি সম্মেলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরিবেশকর্মী শামীম আরফীন বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি আমাদের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু নির্বিচারে এই পানি উত্তোলন ও যথেচ্ছা ব্যবহার আমাদের বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে। বিশেষ করে খুলনা মহানগরী থেকে কী পানি উত্তোলন করা তার নিদিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। এখন প্রতি বাড়িতে উচ্চ ক্ষমতার সাব-মার্সিবল ব্যবহার হচ্ছে। আগে গভীর নলকূপ ব্যবহার হলেও এখন তাতে পানি উঠছে না। ফলে দিন দিন পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন জলবায়ূ পরিবর্তন ও পানি নিয়ে কাজ এই পরিবেশকর্মী আরো বলেন, স্তর নীচে নামার পাশাপাশি পানিতে আর্সেনিক, লবণাক্ততাসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদানের উপস্থিতি বাড়ছে। ফলে এখনই সচেতন না হলে অদুর ভবিষ্যতে এখানে বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটবে।
খুলনা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক এম খাদেমুল ইসলাম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে নলকূপ নিবন্ধনের জন্য নগরবাসীকে আহ্বান জানিয়ে আসছি। বিভিন্নভাবে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছি। কিন্তু তাকে খুব সাড়া মিলছে না। সকল নাগরিক নলকূপ নিবন্ধন হলে ওয়াসার কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো।
খুলনা ওয়াসার জেনারেল ম্যানেজার ও সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস জানান, ওয়াসা নগরবাসীর পানি চাহিদা মেটাতে নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।