স্টাফ রিপোর্টার।।
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে কেমন আছেন খুলনা সিটির সাবেক দুই মেয়র? কোথায় আছেন, কি করছেন এখন, এমন নানা প্রশ্ন তাদের অনুসারীদের মধ্যে। জানা গেছে, দুজনাই বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন, নিশ্চিত অবস্থান জানা না গেলেও একাধিক সূত্র বলেছে, কাজি আমিন ব্যাংককে আছেন।
অন্যদিকে, তালুকদার আব্দুল খালেক ভারতের কলকাতায় আছেন। কেউ কেউ বলছেন, তিনি সিঙ্গাপুরে আছেন। দুজনাই খুলনা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তবে ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের আগে ও পরে তালুকদার আব্দুল খালেক নানা কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। সে প্রেক্ষাপটে কাজি আমিন এখনও বিতর্ক মুক্ত।
খালেক চার আগস্ট গামছা মুড়ি দিয়ে নিজ অফিস থেকে পালিয়ে গেছেন। তারপর থেকে তাকে আর জনসম্মুখে কেউ দেখে নি। তার সেল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো সব বন্ধ। ৪ আগস্ট দফায় দফায় তালুকদার আব্দুল খালেকের বাড়ি ভাংচুর হয়েছে। অন্যদিকে, কাজি আমিনের বাড়ি- ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোন জায়গাতেই হামলা- ভাংচুর- লুটপাট বা অগ্নিসংযোগ কোনটাই হয় নি। জনশ্রুতি আছে, শহরের প্রভাবশালী নেতাদের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক থাকায় কাজি আমিন এ যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যান।
জানা গেছে, আগস্টের প্রথমেই মেয়েকে এগিয়ে দিতে ব্যাংককে যান কাজি আমিন। এর মধ্যে দেশে ঘটে যায় পরিবর্তন। সেই থেকেই কাজি আমিন দেশের বাইরে। ইচ্ছা থাকলেও মামলা থাকার কারণে দেশে আসতে পারছেন না। তবে তার সেল ফোন- ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ সবই খোলা। দলের নেতা-কর্মীরা চাইলেই তাকে ফোন- ইমো বা হোয়াটসঅ্যাপে পাচ্ছেন। ব্যাংকক থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। কয়েক দিন থেকে আবারও ব্যংকক ফিরে গেছেন।
সূত্র বলছে, কাজি আমিন ব্যাংককে ফ্লাট ভাড়া নিয়ে আছেন। নেতা- কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন, কথা বলছেন, প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। দলের অনেককেই সহযোগিতা করছেন, করে আসছেন।
কাজি আমিনুল হক। খুলনার রহস্যময় রাজনীতিক। এরশাদ জামানায় মেয়র ছিলেন। সূত্র বলছে, খুলনা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম প্রশাসক ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। এর পরপরই মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন থেকে খুলনা সিটি করপোরেশনে রুপান্তরিত হয়। যার প্রথম মেয়র কাজি আমিনুল হক। যার পরিচিতি কাজি আমিন হিসাবেই। এর আগে কাজি আমিন খুলনার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন। তখন কাউন্সিলরদের কমিশনার বলা হতো।
জাতীয় পার্টি আমলে কাজী আমিন প্রচন্ড প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। ৯০ এর গণ অভ্যুত্থানে কাজি আমিন আন্দোলনরত বিএনপি- আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পরে গুলি চালিয়েছিলেন এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে খুলনার ছাত্র- জনতা এরশাদের পতনের দিনে ৪ ডিসেম্বর খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠিত জনসভায় এক নম্বর গণদুশমন আখ্যা দিয়ে তাকে এক নম্বর কালো তালিকাভুক্ত করেছিলেন।
সূত্র বলছে, কাজি আমিন গোলাগুলির সময়ে স্পটে ছিলেন না। মামলায় তিনি ছয় নম্বর আসামি ছিলেন। মামলার বাদি ছিলেন, এক সময়ের বিএনপি নেতা সাহরুজ্জামান মর্তুজা। ৯২ এর শেষের দিকে তিনি তৎকালীন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যকে পাশ কাটিয়ে এই মামলার এফিডেভিট করেন।
সেই থেকেই এই মামলার আসামি সাবেক কাউন্সিলর হাসিবুল হক বাবলা, জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আবুল কাশেম, সাবেক যুবসংহতি নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন বাবলু, সাবেক জাতীয় পার্টি নেতা আলি রেজা বাবু সাবেক কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান, সাবেক কাউন্সিলর মোস্তাকিম, সাবেক মেয়র কাজি আমিনুল হক প্রমুখ নেতারা এই মামলায় খালাস পেয়ে যান। সেই সময়ে কাজি আমিন বেশ কিছুদিন জেলও খাটেন।
৯২ তে কাজি আমিন নাটকীয়ভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সুত্র বলছে, কাজি আমিন ৯২তে বিএনপিতে যোগ দেবেন এমন সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত ছিলো। বিষয়টি জানতে পেরে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল তাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সেই থেকেই কাজি আমিন আওয়ামী লীগ করে আসছেন। কাজি আমিনকে শেখ হেলাল সব সময়েই আপন বড় ভাইয়ের মতো মর্যাদা- সম্মান দিয়ে এসেছেন। কাজি আমিনও শেখ পরিবারকে বিশ্বস্ততার সাথে সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা গত ২ দশক ধরে করে আসছেন।
তবে দলে ঢুকে কাজি আমিন বরাবরই কোনঠাসা ছিলেন। প্রথম দশ বছর আওয়ামী লীগের মহানগর শাখার সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। জনশ্রুতি আছে, তালুকদার আব্দুল খালেক ও খুলনাতে বসবাসরত গোপালগঞ্জের গ্রুপ তাকে কোনঠাসা করে রেখেছিলো।
তবে কাজি আমিন এসব বিষয়ে কোনদিনও ভ্রুক্ষেপ করেন নি। আপন গতিতে নিজস্ব স্টাইলেই চলেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় আসলে কাজি আমিন সরকারে আসতে পারেন নি। তাকে চেম্বার ও ব্যবসা বানিজ্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তিনি খুলনা- ৪ আসনের এমপি হচ্ছেন বা জেলা পরিষদ বা কেডিএ”র চেয়ারম্যান হচ্ছেন এমন আলোচনা থাকলেও পরে তা গুঞ্জনই রয়ে যায়।
জনশ্রুতি আছে, কাজি আমিন এই সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি করেন। লক্ষনীয়ভাবে দফায় দফায় চেম্বারের সভাপতি হয়ে কারো কারো কাছে সমালোচনার মুখে পড়লেও কাজি আমিন সেই সময়ে খুলনাতে নিজস্ব ইমেজ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। সময় মেইনটেইন- কমিটমেন্ট- নিজস্ব ব্যক্তিত্বের কারনে মিষ্টভাষী কাজি আমিন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রকৃত অভিভাবক হিসাবে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা পান। তিনি তাদের কাছে ছিলেন আস্থার প্রতীক।
৯১- ৯৬ মেয়াদে বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাকালে ৯৫ সালে ২৫ এপ্রিল খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট, খুলনা মহানগর জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আবুল কাশেম প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হলে কাজে আমিন সেই মামলায় প্রধান আসামি হন। সেই সময়েও তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। পরে প্রায় ২৬ বছর পরে মামলার রায়ে তিনি বেকসুর খালাস পান।
অন্যদিকে, ৯০ এর দশক থেকে তালুকদার আব্দুল খালেক সব সময়েই ক্ষমতায় ছিলেন। হয় তিনি এমপি, না হয় তিনি মন্ত্রী, না হয় তিনি মেয়র বা তার বউ এমপি বা মন্ত্রী ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে ছিলেন, এমন সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে, ৯৬ তে প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তিনি একাধিক মেয়ের সাথে পরকিয়াতে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময়ে একজন প্রতিমন্ত্রীর পরকিয়া এমন শীর্ষক সংবাদ ঢাকার এরশাদের মালিকানাধীন দৈনিক জনতায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদে তিনি স্ত্রীকে ব্যাপক নির্যাতন করতেন এমন খবরও প্রকাশিত হয়।
২০০৯ এ আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসলে তালুকদার আব্দুল খালেকের অধপতন ঘটে। খুলনা সিটির মেয়র হলে তিনি ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি- অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। ৮০র দশক থেকে ক্লিন ইমেজের রাজনীতিক হিসাবে গড়ে উঠা তালুকদার আব্দুল খালেক ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ে তিনি একটি ব্যাংকের পরিচালক, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হয়ে যান। খুলনাতে এ হোসেনের ব্যবসায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও অংশিদার ছিলেন তিনি।
অভিযোগ আছে, বিল- কেউ ঠিকাদারি করলে তাকে নির্দিষ্ট অংশের টাকা কমিশন দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এই সময়ে তিনি নামে বেনামে ঠিকাদারিও করতেন। সেই সময়ে কথায় কথায় হুয়ারের বাচ্চা, সব সময়ে লোকজনের সাথে তিনি দূর্ব্যবহার ও বদমেজাজের কারণে বিশেষ পরিচিতি পান। তার দূর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সোনাডাঙা থানার তৎকালীন সভাপতি বুলু বিশ্বাসের সাথে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন যা পরে শেখ বাড়িতে সালিশ মীমাংসা হয়।
এসব নানা অপকর্মের পাশাপাশি তিনি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচয় দেয়া শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, আয় বহির্ভূত ব্যয়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে দুদকের তদন্ত শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে দুদকে। খালেক ও তার স্ত্রীর ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করেছে দুদক।
দল ক্ষমতাচ্যুত হলে তালুকদার আব্দুল খালেক পালিয়ে যান। এর পর থেকে তিনি নিজেকে সবার কাছ থেকে গুটিয়ে নেন। অভিযোগ আছে, তিনি সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। ফোন- হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমোতে যোগাযোগ করেও তার কনও বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
গত চার দশক রাজনীতিতে তালুকদার খালেক এমন কোন অপকর্ম নেই, যা তিনি’করেন নি। মেয়র থাকাকালে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি তৃণমূলের কোন নেতা-কর্মীদের সাহায্য সহযোগিতা করেননি। তার সাথে দেখা করতে গেলেই দলের নেতা হোক, কর্মী হোক, এমনকি সাধারণ মানুষও অপমানিত হয়েছেন। এটা ছিল ওপেন সিক্রেট। জানা গেছে, তিনি আর রাজনীতিতে ফিরছেন না, এটা এক রকম নিশ্চিত। নেতাকর্মীদের কাছে তিনি এখন খলনায়ক।