যুবলীগ নেতা কালা শওকত, হাফিজ, পলাশ, নাহিদ মুন্সীরা এখনো ধরাছোয়ার বাইরে

729
কালা শওকত
Spread the love

পতিত সরকারের দোসর সমাচার-১

মিলি রহমান ।।
খুলনার আলোচিত শেখ বাড়ির আর্শিবাদে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে মহানগরী দাপিয়ে বেড়ানো যুবলীগ নেতা শওকত হোসেন ওরফে কালা শওকত, হাফিজুর রহমান হাফিজ, শফিকুর রহমান পলাশ, নাহিদ মুন্সীরা এখনো ধরাছোয়ার বাইরে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়ে নগরবাসির মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
৫আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতির মুখে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের সেনা-পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছিল এক মাস ৫দিন আগে। গত শনিবার যখন এই অভিযানের এক মাস পুরো হচ্ছে, তখন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। জেলায় জেলায় অভিযান চলানোর পরও দেশের আইনশ্ঙ্খৃলা পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। বিশেষ করে গত তিন মাসে খুলনা জেলা ও নগরীতে ৮ট হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মোটরসাইকেলে সন্ত্রাসীদের মহড়ার ঘটনা ঘটেছে ১০-১১টি। নগরবাসীর অভিযোগ, নগরীতে আগের মতো পুলিশের টহল ও অভিযান দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া কারাগারে থাকা বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে এসেছে। পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরেছে। সক্রিয় হয়ে উঠেছে তিন-চারটি কিশোর গ্যাং। আর এসব কিছু নিয়ন্ত্রনে রয়েছে খুলনা নগরীর একসময়ের সন্ত্রাসীদের গডফাদার শওকত, হাফিজ, পলাশ ও নাহিদ মুন্সীরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর জিন্নাহপাড়া, মোল্লাপাড়া, লবণচরা ও শিপইয়ার্ড এলাকায় কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। মাদক বেচাকেনাও বেড়েছে। এ ছাড়া আগে বড় কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশের যে তৎপরতা বা অভিযান থাকতো, সেটাও ঝিমিয়ে পড়েছে।
মহানগর বিএনপি গত ২৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে নগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পুলিশ কাজে ফিরলেও তাদের আচরণ ও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। নির্ভরযোগ্য সুত্র দাবি করেছে যুবলীগ নেতারা নগরীতে অবস্থান করলেও তাদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ। যুবলীগের ওইসব নেতারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা নগরীকে অস্থির করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করছে। নিজেদের ব্যবসাবানিজ্য পরিচালনা করছে নির্বিগ্নে।
অবৈধ অস্ত্রধারী কালা শওকত এখনো ধরাছোয়ার বাইরে:
শওকত হোসেন ওরফে কালা শওকত। নগরীর সর্বমহলে একটি আলোচিত নাম। কারো কাছে চাঁদাবাজ, কারো কাছে দখলদার, সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত তিনি। শেরে বাংলা রোডের শেখ বাড়ির প্রভাব খাটিয়ে তিনি এমন কোন অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের সাথে সাথে শওকত হোসেনও রয়েছেন আত্মগোপনে। ইত:মধ্যে নগরীর একাধিক মামলার আসামী হয়েছেন তিনি। এক সময়ের নুন আনতে পান্তা ফুরায় পরিবারে জন্ম নিয়ে অনেক কষ্টে বেড়ে উঠেছেন। শেখ সোহেলের আস্তাভাজন ও বিশ্বস্ত হয়ে অবৈধ টাকার পাহাড় বানিয়েছেন সে। নগরীতে একাধিক আলিশান বাড়ি-গাড়ি ও জমির মালিক হয়েছেন। চাউর আছে কত টাকার মালিক শওকত হোসেন তা সে নিজেও জানেন না।
২০১৪ সালে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম আত্মসাৎ, টেন্ডার চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে খুলনা মহানগর ২৬নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শওকত হোসেন ওরফে কালা শওকতের। পশ্চিম বানিয়াখামার বিহারী কলোনীর মোড়ের বাসিন্দা মৃত আব্দুল আলিম এর পুত্র শওকত। পিতা দর্জি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং তিনি পারিবারিকভাবে খুবই দরিদ্র ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। ২০০৯ সালে খুলনা মহানগর ২৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের আহ্বায়ক হিসেবে যোগদান করেন, যুবলীগে যোগদান পরবর্তী সময়ে তিনি অবৈধভাবে বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে পশ্চিম বানিয়াখামার এলাকায় দুইটি একতলা বাড়ি, একটি চারতলা বাড়ি, বটিয়াঘাটা উপজেলাধীন হেতালবুনিয়া এলাকায় ২০ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়ি, মাহজামিল মিন্টু নামে দুইটি কার্গো জাহাজ, দুইটি প্রাইভেটকার, একটি জীব গাড়ি নং (ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩-৯৮৬০), ঢাকাস্থ বনানী মিরপুর গুলশান এলাকায় তিনটি ফ্লাট এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাতকাটা কাটা জমি ক্রয় করেন। ২০১৪ সালের ০৫ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান মেরিটস ফায়ার এন্ড মেরিন ইন্সুরেন্স কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে বিনামূল্যে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম (যা ওই সময়ের বাজার মূল্য ৯০ কোটি টাকা) প্রদান করে। উক্ত গম শওকাত হোসেন ওরফে কালা শওকাত মালিকানাধীন শিপিং এজেন্ট ও তার গুদাম চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে খালাসের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উক্ত গম খালাস এর ব্যাপারে উচ্চ আদালতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে শওকাত হোসেন ওরফে কালা শওকাত বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে যোগসাজসের মাধ্যমে সুকৌশলে অবৈধভাবে উক্ত গম বিক্রি করে তিনি তা আত্মসাৎ করেন। দৈনিক পত্রিকা প্রথমআলো ২০১৭ সালের ০৮ আগস্ট শওকতের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দুদকসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তদন্তে গম চুরির ঘটনায় শিপিং এজেন্ট ও গুদামের মালিক শওকাত হোসেন ওরফে কালা শওকাতসহ ০৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়। মামলার প্রধান আসামি চুরির মূলহোতা শওকাত হোসেন পুলিশকে বড় অংকের উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন। এছাড়াও উক্ত গম চুরির বিষয়ে গত ২০ জুন ২০১৭ তারিখে হাইকোর্টে বিদেশি লেনদেন নিষ্পত্তি বিভাগ (অ্যাড মেরালটি বিভাগ) এবং ০২ আগষ্ট ২০১৭ তারিখে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত মহানগর হাকিমের আদালত কর্তৃক শিপিং এজেন্ট ও গুদামের মালিক শওকাত হোসেন ওরফে কালা শওকাতসহ ০৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। শওকাত হোসেন ওরফে কালা শওকাতসহ অন্যান্য আসামিগন সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তিন বছর ধরেই এই গম চুরির কেলেঙ্কারির সুরাহা না হওয়ায় বিদেশে বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়।
শওকাত হোসেন ওরফে কালা শওকাত গত ২০০৯ সালে খুলনা মহানগরীর ২৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণের পরবর্তী সময়ে তিনি স্থানীয় এলাকায় মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং চাকরি দেওয়ার নামে টাকা আত্মসাতের বিষয়ে গ্রহণযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, সাতক্ষীরা থেকে খুলনার ডুমুরিয়া দিয়ে ফেন্সিডিল, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য খুলনা মহানগরীতে আমদানি করে খুলনা শেরেবাংলা রোড রাজিব বাজার বিপরীত পাশে এলাকায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান খুলে তার পিছনে রাতে মদ, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের আসর বসাতেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ সোহেল এর নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সড়ক বিভাগ, এলজিইডি, গণপূর্ত বিভাগ, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করার অনেক অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। গোয়েন্দা সুত্রের দাবি শওকত বাহিনীর কাছে ০৪টি বন্দুক এবং পিস্তলসহ প্রায় ১০টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এছাড়া শওকাতের আপন মেজো ভাই কালা রিপন ময়লাপোতা মোড়ে সন্ধ্যাবাজারের বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি জোরপূর্বক দোকান দখল করে সে বর্তমান ০৮টি দোকান ও পাওয়ার হাউজ মোড় এলাকায় খান পেট্রোল পাম্প এর মালিক হয়েছিলো। তিনিও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ সোহেল এর প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বাড়ি, জমি দখলসহ বিভিন্ন প্রকার অসামাজিক কাজে লিপ্ত রয়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়।
শওকাতের বড় ভাই মোরশেদ আহমেদ টুটুল ২০১৫ সালের ২৫ জুন শেখ সোহেল এর মাধ্যমে সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। ইতিপূর্বে তিনি গত ১৯৯৭ সাল হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং বিএনপি’র সকল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয় কর্মী হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া তিনি ২৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে জানা যায়। আওয়ামী লীগে যোগদানের পর থেকে তিনি টেন্ডারবাজি, জবরদখল, চাঁদাবাজি শুরু করে অতি দ্রুত বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন। এ ব্যাপারে শওকত ওরফে কালা শওকতের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তাদের মধ্যে এখন আগের মতো ভয় নেই। এর ফলে অস্ত্রের মহড়া ও হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে।
তবে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘মূলত মাদক বেচাকেনা-সংক্রান্ত বিরোধ এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে এটা ঠিক, কিন্তু পুলিশের তৎপরতা মোটেও ঝিমিয়ে পড়েনি। আমরা নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্রধারী ও এজাহারভুক্ত মামলার আসামীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করছি। টহল কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।’ (চলবে)