ভারতের ঋণে ঝুলে থাকা প্রকল্প বাতিল

3
Spread the love


খুলনাঞ্চল রিপোর্ট।।

ভারতের ঋণে বাস্তবায়নাধীন অনেক প্রকল্প বছরের পর বছর ধরে ঝুলছে। তাদের তুলে ধরা নানা অজুহাতের কারণে কিছু প্রকল্পের মোটেও অগ্রগতি নেই; অগ্রগতি নেই দরপত্র প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত অনুমোদন কিংবা অর্থছাড়েও। অথচ এসব প্রকল্পের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারকে একদিকে কমিটমেন্ট চার্জ গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে সময়ক্ষেপণের কারণে প্রকল্পের খরচও বাড়ছে। সঙ্গত কারণেই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে দুই দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় বেশ কিছু প্রকল্প বাতিলে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ।


বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধি রামপাল প্রকল্পসহ আরও কিছু সমস্যা তুলে ধরলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা অনেক যুক্তি দেখানো হয়। পরে উভয় দেশ চলমান কয়েকটি প্রকল্প বাতিলে সম্মত হয়। এর মধ্যে রেলওয়ের আওতাধীন তিনটি প্রকল্প হচ্ছে- বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ, পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথ নির্মাণ ও খুলনা-দর্শনা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প।

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ জানান, বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সম্মতিতে কয়েকটি প্রকল্প বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের সম্মতি পেলেও আইনি ও কারিগরি দিক খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিছু প্রকল্পের দরপত্র চলমান আবার কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলমান। তাই নানা দিক খতিয়ে কার্যকর পথ বের করতে কাজ করবে এ কমিটি। সেখানে রেলসহ বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন গতকাল বলেন, ভারতীয় ঋণে অনেক প্রকল্প চলমান। এর মধ্য থেকে তিনটি প্রকল্প বাতিল হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। চলমান এসব প্রকল্পের গতি নেই বললেই চলে। তাই বিকল্প অর্থায়নের পথ খুঁজবে সরকার।

জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয়ে প্রকল্পের নামে অপচয় করা হয়েছে। এর বিপরীতে ঋণ ও সুদের জের টানতে হবে বহুদিন। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও উপেক্ষিত ছিল বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া রেলপথ নির্মাণ করা হলে সময় সাশ্রয় হবে তিন ঘণ্টা।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিপুল অংকের অর্থ ব্যয়ে গুরুত্বহীন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তৎকালীন সরকার। অথচ বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের উদ্যোগ অন্তত দেড় যুগ আগের। ২০১০ সালে প্রাক সমীক্ষা করা হয়। বহু ধাপ পেরিয়ে শেখ হাসিনার সরকার প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় ভারতীয় ঋণে (এলওসি-৩)। এ ঋণে প্রকল্পটি যুক্ত করার খেসারত হচ্ছে- বছরের পর বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও ভারতের পক্ষ থেকে চিঠির জবাব মেলেনি। নির্মাণকাজ শুরু তো দূরের কথা। প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ও মেজর সেতু নির্মাণ সংক্রান্ত প্যাকেজ ডব্লিউ-৩ এর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শর্টলিস্ট করতে প্রি-কোয়ালিফিকেশন ডকুমেন্ট ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। চুক্তি অনুযায়ী দেশটির ওই ব্যাংক অর্থছাড় দেওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত ওই চিঠির কোনো জবাবই মেলেনি। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর ভারতীয় দূতাবাসে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয় নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রকল্পের কর্মপরিধি বেড়ে যাওয়ায়। সেখানে অতিরিক্ত ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের কথা বলা হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর আরেক দফা তাগিদপত্র দেওয়া হয। এরও কোনো জবাব দেয়নি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পের বড় চ্যালেঞ্জ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ৭৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকে আর ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে। এটিও অযৌক্তিক ও কঠিন শর্ত। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে গেছে। এ ধরনের কঠিন শর্ত অন্য প্রকল্পগুলোতেও যুক্ত করা হয়েছে। তা ছাড়া নির্ধারিত সময়ে ঠিকাদার নির্ধারণ করা যায়নি।

ট্রেনে বগুড়া থেকে দীর্ঘপথ ঘুরে ঢাকার দূরত্ব ৪০৫ কিলোমিটার। যানজট ছাড়া এ পথে বাসে যেতে সর্বোচ্চ সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। অথচ ট্রেনে যেতে অনেক বেশি সময় ব্যয় হয়। বর্তমানে ১১২ কিলোমিটার পথ ঘুরে উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে সান্তাহার জংশন, নাটোর ও পাবনা ঈশ্বরদী হয়ে বগুড়ায় যেতে হয়। প্রস্তাবিত রেলপথটি নির্মিত হলে সাশ্রয় হবে ৩ ঘণ্টা আর কমবে অর্থ অপচয়। ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা প্রকল্পটির। বাধ্য হয়ে আবারও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩০ জুন ধরা হয় বাস্তবায়নকাল।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, মূল অনুমোদিত প্রাক্কলনের মধ্যে ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭৯ মিলিন ডলার। এটি বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭৯ মিলিয়ন হয়েছে। এতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন। অতিরিক্ত এ অর্থায়নের জন্য ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সভায় উপস্থাপন করা হয়। এটি ২০তম, ২১তম ও ২২তম সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ রয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থায়নের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয় ২০২৩ সালে। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো জবাব পায়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ভারতীয় ঋণের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে প্রকল্পের কাজে। ভারতের পক্ষ থেকে ‘না’ জবাব পেলেও বিকল্প অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধান করা যেত। এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না ওই জবাবের অভাবে। আর সেই ‘জবাব’ পাওয়া গেল গত ৫ ও ৬ মার্চ ইআরডিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে।

ভারতীয় ঋণে বাতিল হওয়া রেলের আরেকটি প্রকল্পের নাম খুলনা-দর্শনা সিগন্যালিংসহ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পেরও নির্ধারিত সময়ে ভূমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদার চূড়ান্তকরণ, পরামর্শ সেবা সবই আটকে আছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কারণে। ১২৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ এখন অনিশ্চয়তায়। এখানেও চুক্তির শর্তানুযায়ী কেনাকাটায় ৭৫ ও ২৫ শতাংশের মারপ্যাঁচ রয়েছে। একই চিত্র পার্বতীপুর-কাউনিয়া মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের প্রকল্পের ক্ষেত্রে। ৫৭ কিলোমিটার রেলপথের এ প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়নসহ যাবতীয় কাজ আটকে আছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কারণে। রেলের প্রকল্প নিয়ে আলোচনা উত্থাপিত হলে সেখানে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানায় রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা তুলে ধরার চেষ্টা করে ভারতীয় প্রতিনিধি। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে আলোচনার অনুরোধ করলে ওই দেশের প্রতিনিধিরা পরবর্তী সময় সম্মত হয় অসমাপ্ত প্রকল্পের ইতি টানতে। ভারতীয় ঋণে চলা অন্য প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি কম হলেও আপাতত রেলের তিনটি প্রকল্প বাতিলে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ। আবার বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা আছে। যেমন- স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে আখাউড়া-আগরতলা এবং খুলনা-মোংলা রেলপথ উদ্বোধন হয়েছে। কিন্তু ওই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন চলছে না। মালবাহী আর কমিউটার ট্রেনই ভরসা। এ ছাড়া কুলাউড়া-শাহবাজপুর এবং ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েলগেজ ডাবললাইন প্রকল্পের অবস্থাও আশাব্যঞ্জক নয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ার সঙ্গে ভারতের আগরতলা রেলপথটি যুক্ত করতে প্রকল্প নেওয়া হয় ভারতীয় অনুদানে। আখাউড়ার গঙ্গাসাগর স্টেশন থেকে ভারতের আগরতলার নিশ্চিন্তপুর স্টেশন পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনার পরিকল্পনা ছিল। এ রেলপথে কবে ট্রেন চলবে তা কেউই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। বলা হয়, বাংলাদেশের চেয়েও ভারতের বেশি সুবিধার্থে এ প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।-আমাদের সময়