কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি।।
১২ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা ফুলবাগানে ফুটে আছে জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, গাঁদাসহ হরেক জাতের ফুল। বিদেশি জারবেরার রঙবাহার চোখে পড়ার মতো। এই ফুল লাল, সাদা, হলুদ, গোলাপিসহ ৮টি রঙে রঙিন করে রেখেছে বন্ধু এগ্রো ফার্মের বাগানটি। বাগানটির অবস্থান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গায়। মঙ্গলবার বিশেষ নজরদারিতে ঘ্রাণহীন জারবেরার পরিচর্যা চলছিল। অপরূপা এই ফুলের কোনোটি ফুটন্ত, কোনটি অর্ধেক ফুটেছে, কোনোটি সবেমাত্র কুঁড়ি। পরিচর্যার উদ্দেশ্য ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলা তিনটি বিশেষ দিন সামনে রেখে।
বন্ধু এগ্রো ফার্মটি সাত বন্ধুর উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় ২০২১ সালে। বর্তমানে পরিচালক হিসেবে এর সার্বিক দেখভাল করেন বালিয়াডাঙ্গার বাসিন্দা শেখ রাসেল আহম্মেদ। ছাত্রাবস্থায় অন্য বন্ধুদের নিয়ে নতুন কিছুর পরিকল্পনা করেছিলেন। রাসেল আহম্মেদ জানালেন, ফেব্রুয়ারিতে পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেনটাইনস ডে ও একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের ব্যাপক চাহিদা থাকে। এ সময় ফুলের কাটতিও প্রচুর। তাঁর বাগান থেকে সব মিলিয়ে চলতি বছর ৪০-৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন।
ফুল উৎপাদনে দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে কালীগঞ্জের। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর পরই ফুলপ্রেমীদের কাছে নজর কেড়েছে এ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম। এখান থেকে সারাদেশে পাঠানো হয় হরেক রকমের ফুল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, দেশে ফুলের চাহিদার অর্ধেকই এই দুই উপজেলার চাষিরা পূরণ করেন।
চলতি বছরে কালীগঞ্জের প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে ফুলের। এর মধ্যে বিদেশি জাতের লিলিয়াম, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, থাই গোলাপ, গ্লাডিওলাসের পাশাপাশি রয়েছে দেশীয় জাতের রজনীগন্ধা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ভুট্টাফুল, গাঁদাসহ বাহারি ফুল। তিনটি উল্লেখযোগ্য দিবস সামনে রেখে উপজেলার ফুলবাগানগুলোতে এখন রাজ্যের কর্মব্যস্ততা। চাষিরা এই সময়ের মধ্যে আনুমানিক ৬ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন।
বালিয়াডাঙ্গার মডার্ন এগ্রো ফার্মের আওতায় ২৯ বিঘা জমি। প্রতিষ্ঠানের মালিক মিজানুর রহমানের ভাষ্য, তিনি গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধাসহ অন্যান্য ফুলের চাষ করেন। এবার ১০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে।
উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের ডুমুরতলা গ্রামের চাষি মিজানুর রহমান চাষ করেন গাঁদা ফুলের। ওই এলাকার অনেকেই এই ফুল চাষে জড়িত। মিজানুর বললেন, দড়িতে ফুল গেঁথে ঝোপা তৈরি করা হয়। একটি ঝোপায় ৬৫০-৭০০টি গাঁদা ফুল থাকে। প্রতি ঝোপা গাঁদা বিক্রি করে এবার সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন। দর কম থাকলে তাদের লোকসানও গুনতে হয়।
জেলার প্রথম ফুল চাষের দাবিদার ত্রিলোচনপুর গ্রামের টিপু সুলতান। এ চাষে জড়িয়ে আছেন প্রায় ৩০ বছর। ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ২৩ বিঘা জমিতে তাঁর বাগান। এর মধ্যে দুই বিঘা জমিতেই গোলাপ চাষ করেন। এ ছাড়া ৬ বিঘা জমিতে জারবেরা, দুই বিঘাতে গ্লাডিওলাস, তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা ফুল, দুই বিঘায় চন্দ্রমল্লিকা ফুলের আবাদ রয়েছে। এ ছাড়া বোতাম ফুল, জিপসি ফুলেরও চাষ করেন তিনি। চলতি মৌসুমে ৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন টিপু সুলতান। ঢাকায় তাঁর ফুলের ব্যবসা দেখাশোনা করেন ছোট ভাই।
ঢাকার শেরেবাংলা নগর ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেডের সহসভাপতি পদে আছেন টিপু সুলতান। তিনিই সর্বপ্রথম এদেশে গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ শুরু করেন বলে জানান। তাঁর ভাষ্য, গ্লাডিওলাসের পর জারবেরার চাষও শুরু করেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে দেশে আনেন নেদারল্যান্ডসের লিলিয়াম ফুল। সেখান থেকে ২৯ লাখ টাকায় ৬০ হাজার পিস লিলিয়াম ফুলের বীজ কেনেন। জাহাজ ভাড়াসহ এই ফুলের জন্য তাঁর মোট খরচ হয় প্রায় ৪৬ লাখ টাকা। প্রথম বছরে এই ফুল খুব একটা বিক্রি করতে পারেননি। তবে পরের বছর থেকে পুরোদমে লিলিয়াম ফুল বিক্রি হতে থাকে।
টিপু সুলতানের বাগান দেখাশোনায় স্থায়ী কর্মী আছেন সাতজন। এর বাইরেও দিনে ১৫-২০ জন দৈনিক পারিশ্রমিকে কাজ করেন। স্থায়ী কর্মীদের মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা বেতন দেন। অন্যদের দিনে ২০০ টাকা হাজিরা দেন। পরিচর্যা, সেচ, সার, ওষুধ, পরিবহনসহ প্রতিবছর তাঁর বাগানের জন্য খরচ হয় ২৪-২৫ লাখ টাকা। ৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করলে এসব খরচ বাদ দিয়েও ২৫-৩০ লাখ টাকা মুনাফা হয় তাঁর।
ব্যবসায়ী টিপু সুলতানের ভাষ্য, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুলের ব্যবসা ভালো হয়। এ সময় ফুলের দামও মেলে ভালো। কয়েক দিনের মধ্যে ভ্যালেনটাইনস ডে, পহেলা ফাল্গুন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পড়ে ফেব্রুয়ারিতে। এই সময়ের মধ্যে তিনি একাই ১০-১৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারেন। চলতি বছর কালীগঞ্জ থেকে এই তিনটি দিবস সামনে রেখে ৬-৭ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে।
এদিকে কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গার পাশের লাউতলা বাজারে গড়ে উঠেছে ফুল বিক্রির বাজার। মঙ্গলবার সরেজমিন বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জের মেইন বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, দুপুর থেকেই শত শত কৃষক ক্ষেতে উৎপাদিত ফুল নিয়ে আসছেন ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন যানবাহনে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আশপাশ ছেয়ে যায় বাহারি ফুলে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনির ভাষ্য, পুরো জেলার মধ্যে কালীগঞ্জেই ফুলের চাষ সবচেয়ে বেশি। চলতি বছর উপজেলার প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলের চাষ হয়েছে। এতে সম্পৃক্ত ৭-৮শ চাষি। কৃষি বিভাগ থেকে তাদের সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়।