ঢাকা অফিস।।
দেশের পরিস্থিতি অনুকূলে থাকতে থাকতে দ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি। এ জন্য গণ-অভ্যুত্থানে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমতল মাঠ তৈরি করতে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারও চায় দলটি। এক্ষেত্রে বেশি সময় দিতে চায় না বিএনপি। ডিসেম্বরে সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পর আগামী বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে দলটি। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, সরকারের সংস্কার কার্যক্রম দেখে তারা নির্বাচনের দাবি তুলবেন। এ জন্য সামনের দিনগুলোতে সরকারের প্রতি চাপ বাড়ানো হবে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে রাষ্ট্রের প্রতিটি কাঠামো ধ্বংস করে ফেলেছে। এ কারণে সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় ধরে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বা সরকারের প্রত্যাশিত গতি আসেনি। সরকারের এই দুর্বলতার কারণে বারবার পতিত সরকারের লোকজনসহ বিদেশিরাও নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই দ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারের কাজ শেষ করে জাতীয় নির্বাচন দেওয়া জরুরি। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার কথা বলেছে দলটি। তা না হলে পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, সরকারের দুর্বলতায় ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে বলেও মনে করেন বিএনপি নেতারা।
চায়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর গত বৃহস্পতিবার জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে মিনিমাম সংস্কার করতে হবে। আমাদের ৪১ দফা আছে। এই সরকারের জন্য দিয়েছি মাত্র ১০ দফা। তাদের (সরকার) কাছে হস্তান্তরও করেছি। এই সংস্কারগুলো দ্রুত করা দরকার। এই সংস্কারগুলো করে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেওয়া উচিত।
জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াত শুধু বক্তব্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠও গোছাচ্ছে উভয় দল। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী আসনে এখন সক্রিয়। নেতারাও জনসংযোগের পাশাপাশি যোগ দিচ্ছেন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে। ঐক্য ও শান্তির বার্তা দেওয়ার সঙ্গে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন গঠনের ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। এরই মধ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানান, জরুরি সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে সরকার। তবে সেটি সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এমন অবস্থানেও আস্থা পাচ্ছেন না বিএনপি নেতারা। তারা বলেন, সরকার রোডম্যাপ ইস্যুতে যদি তাদের অবস্থান স্পষ্ট না করে, তাহলে পরিস্থিতি যে কোনো সময় গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির বিপক্ষে চলে যেতে পারে। এমন আশঙ্কা রয়েছে বিএনপি নেতাদের মাঝে। গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, পরিকল্পিতভাবে ভয়াবহ অবস্থা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। আন্দোলনকে (জুলাই-আগস্ট) ভিন্ন দিকে নেওয়া হচ্ছে। এমন কিছু কাজ হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে।
গত কয়েকদিনে নৈরাজ্যের পেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি ও জামায়াতের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন দল দুটির নেতারা। পাশাপাশি দেশের শান্তি বিনষ্টকারী শক্তিকে প্রতিহত করতে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য গঠনে উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানান তারা। সেখানে তুলে ধরেছেন দ্রুত সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা।
বিএনপি নেতারা বলেন, তারা চান ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করুক এবং মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করুক। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপক্ষে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সরকার গঠিত হয়, তাহলে ওই সরকার মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মর্মবাণী বুকে ধারণ করে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে অন্যান্য সংস্কার কাজ করবে ও দেশ পরিচালনা করবে।
এই নেতারা বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচন দাবি করে। এরপর দলের পক্ষ থেকে সরকারকে যৌক্তিক সময়ের দেওয়ার কথা বলা হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার কাজ শেষ করে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে। সমমনা দলগুলোও একই দাবি জানাচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতারা বলেন, বর্তমান সরকার একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হোক, তা আমরা চাই না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাতে না যায়, সেজন্য তারা দ্রুত নির্বাচন চাইছেন। কাক্সিক্ষত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না দিলে তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে অনুযায়ী, এখন থেকেই সরকারকে বার্তা দিতে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন।
বিএনপি মনে করে, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একসঙ্গে চলতে পারে। বিএনপির সঙ্গে সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের স্পষ্ট ঘোষণা চায়।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন সম্পর্কিত সংস্কার কার্যক্রম, নির্বাচনী রোডম্যাপ ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচনমুখী সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে, একটি নির্বাচন আয়োজন করা। এ জন্য কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির মাধ্যমে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। তাই নির্বাচনমুখী সংস্কারকে এখন প্রাধান্য দিতে হবে।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, সাড়ে তিন মাসের বেশি হলো অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। অবিলম্বে তাদের নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত।