মুক্তির মিছিল ঐতিহাসিক ৭ই নভেম্বর

9
Spread the love


ড.ফোরকান আলী
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেই সব দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা যায় না। কিছু সংখ্যক মানুষ, কতিপয় রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সেই সব ঘটনার নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর যতই চেষ্টা করুক না কেন, দেশের ইতিহাসে সেই ঘটনা ও দিন নিজস্ব গরিমায় ভাস্বর হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ও এদেশের গণমানুষের নিকট ৭ই নভেম্বর তেমনি একটি দিন। ৭ই নভেম্বরের সিপাহি-জনতা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতা থেকে কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যেভাবে এদেশের মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠেছিল, ঠিক তেমনিভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর উপমহাদেশের আধিপাত্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক আওয়ামী-বাকশালী শাসকদের হাতে পুনরায় নিপতীত হওয়ার সম্ভাবনা মুক্ত হওয়ার আনন্দে দেশের লক্ষ কোটি মানুষ আবার রাস্তায় নেমেছিল। ৭ই নভেম্বর সিপাহি-জনতা বিপ্লবকে অনুধাবন করতে হলে এর পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, ১৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটেনও বিবেচনায় আনতে হবে। একথা সবাই জানেন যে ১৯৭৫ সালে বাকশাল নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থান একদলীয় বাকশাল সরকারের পতন ঘটে। এই ঘটনায় দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। একই সাথে তার স্ত্রী, ভাই, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট থেকে ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন ছিলেন খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী বাকশাল মন্ত্রীরা। খন্দকার মোশতাক সামরিক শাসনজারি করলেও তার মন্ত্রী সভায় সামরিক বাহিনীর কোন লোক ছিল না এবং তিনি প্রশাসনের কোন পর্যায়েই সামরিক প্রশাসক নিয়োগ করেননি। পার্লামেন্টে অটুট ছিল এবং পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। ১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বর এক পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মোসতাককে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং তিনি বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করেন। সত্যিকার অর্থে সামরিক শাসন শুরু করেন বিচারপতি সায়েম। কারণ তিনি ডেপুটি সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে তিন বাহিনী প্রধানকে নিয়োগ করেন। কিন্তু এই পাল্টা অভ্যুত্থান ছিল ক্ষণস্থায়ী। ৭ই নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে খালেদ মোশাররফ পরাভূত হন এবং তিনি দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। জেনারেল খালেদ মোশাররফ ছিলেন একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কে ফোর্স এর অধিনায়ক। ব্যক্তিগতভাবে খালেদ মোশাররফের এই ধরনের পরিণতি অনেকের নিকট বেদনাদায়ক হলেও ৭ই নভেম্বর পরবর্তি ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে তিনি জনগণের আবেগের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর সকল স্তর, বিশেষ করে সিপাহিদের আবেগেরে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের জনগণ বাকশালী দুঃশাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল, ৩রা নভেম্বরের পাল্টা সামিরক অভ্যুত্থান মানুষকে পুনরায় বাকশালী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাময় আতংকিত করেছিল। যে কারণে ৭ই নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপÍব পরবর্তি সময়ে তাদের সমর্থনে ঢাকার রাস্তায় লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখো মানুষ হাজির হয়েছিল সেদিনের জুমা’র জামাতে। তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট শুকরিয়া জানিয়েছিল, পুনরায় বাকশালী শাসনে আবদ্ধ হওয়ার হাত থেকে নিস্তার পেয়ে। ৭ই নভেম্বর এর সিপাহি-জনতা বিপ্লবের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিবেচনায় নয়, একজন সাধারণ মানুষ যিনি ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক তাৎপর্য অনুধাবনে সক্ষম ছিলেন না, একজন সাধারণ মানুষ, কেনো সিপাহি-জনতার বিপ্লবে সামিল হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্যই বর্তমান প্রবন্ধের অবতারণা।
৭ই নভেম্বরের সফর সিপাহি-জনতার বিপ্লবে লাখো মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে কেন রাস্তায় নেমেছিল এবং আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করেছিল তা অনুধাবন করার জন্য বিশ্লেষণ করতে হবে, শেখ মুজিবের আওয়ামী-বাকশাল শাসনামলে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং একজন ব্যক্তি মানুষের জীবন-যাপন ও নিজস্ব আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তব চিত্র। শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন ছিল, তা অনুধাবন করার জন্য বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। শেখ মুজিবের বাকশালী পার্লামেন্টের স্পিকার ও তৎপরবর্তী আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল মালেক উকিল, খন্দকার মোসতাকের দূত হয়ে লন্ডনে গিয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে দেশ ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। আমার ধারণা তৎকালীন আওয়ামীলীগের সকল নেতাকর্মিই শেখ মুজিব ও শেখ মুজিবের শাসনামল সম্পর্কে আব্দুল মালেক উকিলের মূল্যায়নের সাথে একমত ছিলেন। যদি তাই না হতো, তাহলে কিভাবে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মিরা মালেক উকিলকে আওয়ামীলীগের সভাপতি বানাতে পেরেছিল। শেখ মুজিবের পার্লামেন্টের স্পিকার ও তৎপরবর্তী আওয়ামীলীগের সভাপতি যদি বলতে পারেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে দেশ ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে, তাহলে অনুমান করা যায় সাধারণ মানুষের অবস্থা কি ছিল এবং কেনই বা তারা সিপাহি-জনতার বিপ্লবকে সমর্থন করে রাস্তায় নেমেছিল। শেখ মুজিবের শাসনামল কেমন ছিল, তা অনুধাবন করার জন্য শেখ মুজিবরের কতিপয় উক্তি তার শাসনামলকে মূল্যায়নের নির্ণায়ক হতে পারে। যেমন আওয়ামী-বাকশালী নেতাকর্মিদের লুটপাট, চুরি-চামারীতে অতিষ্ঠ হয়ে শেখ মুজিবর বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, সকল দেশ পায় সোনার খনি, আর আমি পাইছি চোরের খনি। তাঁকে বলতে হয়েছিল বিদেশ থেকে যা কিছু ভিক্ষা করে আনি, চাটার দল সব খেয়ে ফেলে।’ তিনি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন “সাত কোটি মানুষের জন্য সাতকোটি কম্বল এলো, কিন্তু আমারটা কই?”এবার দেখা যাক শেখ হাসিনা মন্ত্রীসভার সদস্য ও তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আ স ম রব শেখ মুজিব শাসনামলকে কিভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন। জনাব রব ১৯৭২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের অনুষ্ঠিত এক জনসভায় লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে বলেছিলেন, মুজিব-তুমি বলেছিলে স্বাধীনতার পর এদেশে কোন লোক না খেয়ে মরবে না, কিন্তু আজ খাদ্যের অভাবে লোকমারা যাচ্ছে। সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের নেতা কর্মিরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কালোবাজারী ও চোরাচালানে লিপ্ত এদেশে। একদিকে বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, অন্যদিকে হাজার হাজার লোককে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হচ্ছে, তাদের উপর চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধে সরকার চালাচ্ছে দমননীতি। আওয়ামীলীগের শাসকেরা পাকিস্তানি শাসকদের তুলনায় বেশি দুর্নীতিবাজ। জনাব রব দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীসভা ও দুর্নীতিবাজ আমলাদের বহিষ্কার ও গ্রেফতার দাবি করেন।
এ্যান্থনী মাসকারনেস তার ইধহমষধফবংয : অ খবমধপু ড়ভ ইষড়ড়ফ বইতে আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশের সমাজ চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, “বাংলাদেশের শহর, বন্দর, গ্রাম, হাট-বাজারে অস্ত্র হাতে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে লুটপাট চালাত ও মানুষ খুন করত। লুটপাটের তালিকায় কোন কিছুই বাদ যেত না। নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার থেকে শুরু করে বাজারের মাছ, ডিম, তরকারি পর্যন্ত লুট করা হতো। চোরাই গাড়ির নম্বর প্লেট ঢেকে রাইফেল ও স্টেনগান হাতে সন্ত্রাসীরা মানুষের বাড়িতে হানা দিত। তাদের দাবি না মানলে রাতে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পুনরায় হাজির হত।”
শেখ মুজিব আমলের দুর্নীতি সম্পর্কে মাসকারনেস লিখেছেন, “পৃথিবীর কোন কোন দেশে দুর্নীতি থাকলেও পৃথিবীর কোন দেশেই তার জন্মলগ্ন থেকে এই ধরনের দুর্নীতি দেখেনি। যেখানে সামান্য লাভের সম্ভাবনা, সেখানেই প্লেগ ও পঙ্গপালের মত দুর্নীতিবাজরা ঝাঁপিয়ে পড়ত। সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগের সকল পর্যায়ের নেতা কর্মি ও আমলারা দূর্নীতিতে জড়িত ছিল। সরকারি দলের লোক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চোরাকাবার ও কালোবাজারী করতেন।”
মুজিব-আমল বর্ণনা করতে গিয়ে মাসকারনেস আরো লিখেছিলেন, মুজিবের আমলে গণভবন ছিল মোঘল দরবারের মতো। এই দরবারে দলে দলে লোক আসতো, আসত মাসায়েবেরা। তারা শেখ মুজিবের গলায় পরাত ফুলের মালা, কেউ পা ছুঁয়ে কদমবুচি করত, কেউ কাঁদত, আবার কেউ কেউ মুজিবের নামে গান গাইত। অনেকে আসত চাকুরি, ব্যবসা বা অন্যান্য তদবিরের কাগজ নিয়ে। মুজিব তাদের হাত থেকে দরখাস্ত নিতেন। পিঠ চাপড়িয়ে বা গাল টিপে আদর করে বলতেন, যাও আমি দেখবো। কিন্তু এই পর্যন্তই। তিনি কিছুই করতেন না কিন্তু সকলকে আশ্বাস দিতেন। শেখ মুজিবুর রহমান মারা যাওয়ার পর কট্টর আওয়ামীলীগের সাংবাদকি এ বি এম মুসা এ প্রসঙ্গে মাসকারনেসকে বলেছিলেন, “ঐব (গঁলরন) ঢ়ৎড়সরংবফ বাবৎুঃযরহম ধহফ নবঃৎধুবফ বাবৎুড়হব.”
এবার দৃষ্টি ফোরানো যাক বাকশাল শাসনের দিকে। বাকশাল শাসন মানুষের মৌলিক অধিকারকে কিভাবে হরণ করেছিল তার বয়ান রয়েছে বাকশাল শাসনের জন্য আনীত সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী ও অন্যান্য বিধিবিধানে। নিম্নে এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আরোচনা করা হলো ঃ
১। বাকশাল ও সংবাদপত্র ঃ বাকশালী ব্যবস্থায় ৪টি বাদে দেশের সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই পত্রিকা চারটিকে জাতীয়করণ বা সরকারিকরণ করা হয় এবং পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের জোরপূর্বক বাকশালে যোগদান করানো হয়। জোরপূর্বক এ কারণে যে, বাকশাল সদস্য না হলে কোন সম্পাদক ও সাংবাদিক পত্রিকায় চাকুরি করতে পারবে না বিধায়, তারা বাকশালে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছিল। এই ৪টি পত্রিকা বাদে অন্য কোন পত্রিকা, সাময়িকী, বুলেটিন, লিফলেট প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। মোট কথা, মানুষের বাক-স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করা হয়। যে চারটি পত্রিকা রাখা হয় সেগুলিকে পত্রিকা না বলে বাকশাল এর মুখপাত্র ও মুজিব বন্দনার কাগজ বলাটাই শ্রেয় ছিল।
২। বাকশাল ও রাজনৈতিক অধিকার ঃ বাকশাল ব্যবস্থায় দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। বাকশাল ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক রাজনৈতিক দল গঠন, সভা সমাবেশ, মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক যারা সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, তাদের বিধান করা হয়, বাকশাল ব্যবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে সকলেই সংসদ পদ হারাবেন। তবে বাকশালে যোগদান করলে সদস্যপদ পুনরায় বহাল থাকবে। অর্থাৎ বাকশালে যোগদান না করলে কেউ সংসদ সদস্য থাকবেন না। বাকশালে যোগদান না করার কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সংসদ সদস্য পদ হারান। বাকশাল দলে ইচ্ছা করলেও কেউ যোগাদন করতে পারতো না। কারণ বাকশাল ব্যবস্থায় বিধান রাখা হয় যে, শেখ মুজিবের অনুমতি ছাড়া কেউ বাকশাল সদস্য হতে পারবে না। এ থেকে বলা যায় যে বাকশাল ব্যবস্থায় মানুষের রাজনৈতিক অধিকারই শুধু হরণ করা হয়নি, এই অধিকারকে এক ব্যক্তি ইচ্ছাধীন করে ফেলা হয়।
৩। বাকশাল সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঃ বাকশাল শাসনামলে দেশের সেনাবাহিনী, বি ডি আর, পুলিশ, রক্ষীবাহিনী ও আনসার বাহিনীর সকল অফিসার ও সদস্যদের বাকশালে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। এই সব বাহিনী প্রধানদের বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ যোগাদনও ছিল বাধ্যতামূলক। কারণ বাকশালে যোগদান না করলে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হতো।
৪। বাকশাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঃ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বাকশালে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যেসব শিক্ষকরা বাকশালে যোগান করবে না তাদের চাকুরিচ্যুত করা হবে। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বাকশাল এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বানানো হয়।
৫। বাকশাল ও বিচার ব্যবস্থা ঃ বাকশাল শাসনের আওতায় দেশের উচ্চ, নিম্ন আদালতগুলিকে দেশের নির্বাহী প্রধান বা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের নিয়ন্ত্রনাধীন করা হয়। ১৯৭২-এর সংবিধানের ৯৫(১) ধারায় বলা হযেছির, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ করবেন ও প্রধান বিচারপতির সাথে আলোচনা করে অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগ করবেন। ৪র্থ সংশোধনীতে এই ধারা পরিবর্তন করে বলা হয়, ‘প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।’ ১৯৭২ এর মূল সংবিধান অনুযায়ী বিচারকদের অপসারণ ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রমানিত অসদাচারণ ও অসমার্থের কারণে একজন বিচারককে অপসারণ করতে হলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আনীত প্রস্তাবে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন থাকলে, একজন বিচারপতিকে অপসারণ করা যেত। কিন্তু ৪র্থ সংবিধানে একজন বিচারকের অপসারণ রাষ্ট্রপতির মর্জির ওপর ন্যস্ত করা হয়। ৪র্থ সংশোধনীতে বলা হয়, অসদাচারণ ও অসামর্থের অভিযোগে রাষ্ট্রপতি কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়ে একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারবেন।’ বিচারপতি কর্তৃক আত্মপক্ষ সমর্থণ বা অভিযোগের সত্যতা যাচাই নয়- কারন দর্শানা নোটিশ দিয়েই বিচারপতিকে অপসারণ-কি তুঘলকী শাসন। অবশ্য জেনারেল জিয়া এই তুঘলকি শাসনের অবসান ঘটান (ঞযব ২হফ ঢ়ৎড়পষধসধঃরড়হ, ড়ৎফবৎ ঘড়. ১ ড়ভ ১৯৭৭, রিঃয বভভবপঃ ভৎড়স ১-১২-৭৭)।
১৯৭২ এর সংবিধানে (১০২-১) মানুষের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা হাইকোর্টকে প্রদান করা হয়। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টের এই ক্ষমতা রহিত করা হয়। জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালে এক সামরিক ডিক্রি বলে হাইকোর্টকে পুনরায় এই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন (২হফ ঢ়ৎড়পষধসধঃরড়হ, ড়ৎফবৎ ঘড়. ৪ ড়ভ ১৯৭৬)। শুধুমাত্র উচ্চ আদালত নয়, নিম্ন আদালতগুলিকেও তৎকালনি নির্বাহী প্রধানের নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়। ১৯৭২ এর মূল সংবিধানে বলা হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি জেলা জজ ও বিচার ব্যবস্থায় নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়োগ সুপ্রিমকোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী করবেন। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনীতে সুপ্রিমকোর্টের সুপারিশ করার ক্ষমতাকে রহিত করা হয় (৪ঃয ধসবহফসবহঃ ধপঃ ড়ভ ১৯৭৫, ধৎঃরপষব, ১১৫)। জেনারেল জিযাউর রহমান এক সামরিক ফরমান বলে সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতা পুনরায় ফিরিয়ে দেন (২হফ ঢ়ৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ৎফবৎ ঘড়. ৪ ড়ভ ১৯৭৮).
এর বাইরে ছিল কুখ্যাত বিশেষ ক্ষমতা আইন, যা এখনো বলবৎ রয়েছে। এই কুখ্যাত বিশেষ ক্ষমতা আইনে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে জেলে ঢুকানো হয়েছিল। এমন একটি পরিস্থিতিতে সরকার বিরোধীদলের দমন করা রজন্য সমগ্র দেশ জুড়ে নামানো হয়েছিল রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সহ বিভিন্ন এলাকার আওয়ামীলীগ মন্ত্রী, এম পি, নেতা কর্মিদের নিজস্ব বাহিনী। বর্তমানে দেশে মানবাধিকার সংগঠন, নতুন শক্তিশালী বিরোধী দল, স্বাধীন উচ্চ আদালত, দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন, নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থায় বর্তমান কালের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হাট-ঘাট, বাজার-দোকান, ঘরবাড়ি-সম্পত্তি দখল ও বিরোধী দল দমনের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে ১৯৭৫ পূর্ব আওয়ামী বাকশালী শাসনের স্বরূপ কেমন ছিল। ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এবং ৭ই নভেম্বরে সিপাহি-জনতার সফল বিপ্লবে কোন দেশের লাখো জনতা রাস্তায় নেমেছিল-তার মর্মার্থ লুকিয়ে আছে ১৯৭৫ পূর্ব আওয়ামী-বাকশাল শাসনের কালো অধ্যায়ের মধ্যে। তাই তো দেখা যায় ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে মানুষের মনে জমাট বেধেছিল শঙ্কা ও ভয়ের কালো মেঘ। তাদের শঙ্কা ও ভয় ছিল, আবার বাকশাল শাসন ফিরে আসে কিনা তাই নিয়ে। ৭ই নভেম্বর মানুষ যখনজানতে পারলো আওয়ামী-বাকশাল শাসনে বন্দী হওয়ার সম্ভাবনা কেটে গেছে, তখনই তারা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ন্যায় সামিল হয়েছিল সিপাহি-জনতার বিপ্লবের কাতারে। সে দিন ছিল শুক্রবার। সিপাহি-জনতার সফল বিপ্লবে এবং দেশের আপামর মানুষের প্রিয় জেনারেল জিয়াকে ফিরে পেয়ে হাজার হাজার মানুষ হাজির হয়েছিল বায়তুল মোকাররম মসজিদে, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়ের লক্ষ্য। ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের মানুষের নিকট নিয়ে এসেছিল এক ধরনের ঈদের আনন্দ। আজকে, অনেকেই অনেক কথা বলছেন। কিন্তু এটাই ছিল ৭ই নভেম্বরের বাস্তবতা। লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ