টিনের বাড়ি থেকে সম্পদের পাহাড় রণজিতের

36
Spread the love


যশোর অফিস
যশোরের তিনবারের সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায় আওয়ামী লীগের শাসন আমলে অবৈধভাবে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এমপি হওয়ার আগে আধাপাকা টিনের ঘরে বসবাস করলেও ১৫ বছরে নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অসংখ্য গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির মালিক হয়েছেন তিনি। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, সরকারি বরাদ্দ লুট, জমি দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যও আলোচিত ছিলেন তিনি।
সংসদ-সদস্য পদ যেন তার কাছে ‘আলাদিনের চেরাগ’ ছিল। ১৫ বছরে দখল, নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্য, সরকারি প্রকল্পে লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক শ কোটি টাকা কামিয়েছেন রণজিত কুমার রায়। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। টিনের বাড়ি থেকে অসংখ্য বিলাসবহুল বাড়ি ও জমির মালিক বনে গেছেন তিনি। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রণজিত কুমার রায়ের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের খাজুরা বাজারটি সমৃদ্ধ জনপদ। এটি এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। একসময় এই বাজারে পানের ব্যবসা করতেন রণজিত কুমার রায়ের বাবা নগেন্দ্রনাথ রায়। পরে লবণের ব্যবসা করেন। খাজুরা বাজারে তাদের একটি পারিবারিক টিনের বাড়ি ছিল। ২০০৮ সালে সংসদ-সদস্য নির্বাচনের আগে থেকেই তারা ওই বাড়িতে বসবাস করতেন। নবম সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় রণজিত কুমার রায় উল্লেখ করেন, তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল সর্বসাকুল্যে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার। এর মধ্যে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক লাখ টাকা মূল্যের চার বিঘা জমি, খাজুরায় চার শতক জমির ওপর ৫০ হাজার টাকা মূল্যের টিনের ঘর। বার্ষিক আয় ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। আর তার স্ত্রী নিয়তি রানীর নগদ ৭০ হাজার টাকা, ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ। আয়ের কোনো উৎস ছিল না। ১৫ বছর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় রণজিত কুমার রায় দাবি করেছেন, তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৫ কোটি টাকার বেশি। আর স্ত্রী নিয়তি রানীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি টাকার বেশি। তবে বাস্তবে তারা অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, যশোর শহরের রেল রোডে রণজিত ও তার স্ত্রী নিয়তি রানীর দুটি বাড়ি রয়েছে। একটি চারতলা। এ বাড়িতে বাস করতেন রণজিত। এ ভবনের এক ভাড়াটিয়া জানালেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের দিনও সংসদ-সদস্য রণজিত রায় বাড়িতে ছিলেন। ওইদিন বিকালে তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন। তার বাড়ির কেয়ারটেকার ভাড়া আদায় করছেন। এই ভবনটি থেকে কয়েক শ গজ দূরে তিনতলা বাড়িটির মালিক রণজিত রায়ের স্ত্রী নিয়তি রানী। এটিও ভাড়া দেওয়া আছে। নিচতলার এক ভাড়াটিয়া জানান, ৫ আগস্টের পর তাদের এলাকায় দেখা যায়নি। কেয়ারটেকার ভাড়া আদায় করেন। শহরের লোহাপট্টিতে সাত শতক জমির ওপর দুইতলা ভবনের বাড়িটির মালিকও রণজিত রায়। এ বাড়ির নিচে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া আছে। ওপরে ভাড়াটিয়ারা বসবাস করেন।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ যশোর উপবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, যশোর শহরের নিউমার্কেট এলাকায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের আবাসন প্রকল্পে সাড়ে ১২শ স্কয়ার ফুটের দুটি ফ্ল্যাটের মালিক রণজিত কুমার রায়। বাঘারপাড়া উপজেলা শহরে দুইতলা ও খাজুরা বাজারে তিনতলা বাড়ি রয়েছে। ঢাকার পূর্বাচলে তার নামে রাজউকের প্লট রয়েছে বলে জানা গেছে। নির্বাচনি এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেকসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে রণজিত কুমার রায়ের।
রণজিত কুমার রায় মূলত ১৫ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে কোটি কেটি টাকা আয় করেছেন। রণজিত, স্ত্রী নিয়তি রানী ও দুই ছেলে রাজীব রায় ও সজীব রায় অন্তত ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তার অবৈধ আয়ের আরেকটি উৎস ছিল টেন্ডার বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কমিশন গ্রহণ। তার পক্ষে টেন্ডার ও প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য তদারকি করতেন ছেলে বাঘারপাড়া উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাজীব রায়, নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাস ও শ্রমিকনেতা রবিন অধিকারী ব্যাচা এবং বাঘারপাড়া পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু।