খুলনাঞ্চল রিপোর্ট
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অনৈতিকভাবে শক্তি প্রদর্শন ও নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, গ্রেফতারও হয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনসহ কয়েকজন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা। দফায় দফায় রিমান্ড-জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। এদিকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর ‘নির্দেশ’ দেওয়া অন্তত এক ডজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, পুলিশ-প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতিরিক্ত কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্রদার ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামসহ অন্তত চারজন প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। অতিরিক্ত কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্রদার ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামসহ অন্তত চারজন প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইজিপির সঙ্গে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সেখান থেকে বেরিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। পরে দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে সুযোগ বুঝে দেশ ছাড়েন তিনি। এতে তাকে সহযোগিতা করেন পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কিছু কর্মকর্তা। এছাড়া রাজধানীর পল্টন থানার একটি মামলার আসামি ট্যুরিস্ট পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি রেজাউল আলমের দেশত্যাগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। তিনি গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে মালয়েশিয়াগামী এমএইচ-১০৩ ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। এদিকে রেজাউলের পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েক দফা চেষ্টা করেও দেশে ছাড়তে পারেননি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তবে ডিএমপির সদ্য সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাকে ভারতের একটি হোটেলে দেখা গেছে বলেও জানা গেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে মালয়েশিয়াগামী এমএইচ-১০৩ ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন ট্যুরিস্ট পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি রেজাউল আলম।
আগস্টের মাঝামাঝিতে দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন ডিবি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ ও ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশ ছাড়েন তারা। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের দেওয়া নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কাজে যোগ দেননি ডিএমপির আরো দুইজন যুগ্ম কমিশনার মেহেদী হাসান ও লিটন কুমার দাস। তাদের অবস্থান সর্ম্পকে কোনো খবর জানা যায়নি।
পুলিশ সদর দফতর বলছে, এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮৭ জন কর্মকর্তা। অনুপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তা দেশত্যাগ করেছেন বলেও জানা গেছে।
ডিএমপির সদ্য সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাকে ভারতের একটি হোটেলে দেখা গেছে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, যে ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য বিভিন্ন কারণে এখনো অনুপস্থিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের অবস্থান জানতে চেষ্টা চালাচ্ছি।
এ বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, এসব অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা গোয়েন্দাদের কাজের ধরন জানেন। এ কারণে তাদের নজরদারিতে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়া পুলিশের বিশেষ শাখাসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অপেশাদার আচরণের কারণেই তারা দেশ ছাড়তে পেরেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুস সাকিব বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন বেশকিছু পুলিশ কর্মকর্তার নাম মানুষের মুখে মুখে ছিল। আওয়ামী লীগ আমলেও এমনটা হয়েছে। এবারের অভ্যুত্থানে জনগণের মূল লক্ষ্য ছিল পুলিশ।
দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন ডিবি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ ও ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
এদিকে আইজিপি থেকে শুরু করে পরিদর্শকসহ পুলিশের সাবেক-বর্তমান অন্তত ২৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ সদর দফতর। তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, এই ২৬ জনকে গ্রেফতারের জন্য তিন ধাপে অনুমতি নেয়া হয়েছে। অনুমতি চেয়ে করা আবেদনে গ্রেফতারের কারণও ব্যাখ্যা করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের সাবেক-বর্তমান এই ২৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই হত্যা মামলা হয়েছে। তারা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো বা নির্দেশ দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত। তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ ৭ জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিরা আত্মগোপনে আছেন। কেউ কেউ বিদেশে চলে গেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন মামলায় আসামি হিসেবে নাম থাকা বিগত সময়ের প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। খুঁজে না পাওয়ায় অনেককে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না।
আইজিপি থেকে শুরু করে পরিদর্শকসহ পুলিশের সাবেক-বর্তমান অন্তত ২৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ সদর দফতর। তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
এদিকে গ্রেফতারের অনুমতির তালিকায় নাম থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কিসের ভিত্তিতে আমাকে গ্রেফতারের অনুমতি নেয়া হয়েছে তা বুঝতে পারছি না। বড় ঘটনার সময় কোনো এলাকায় কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন। সেখানে সব দায় শুধু একজনের ওপর চাপানো ঠিক নয়।
পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, এই ২৬ জন ছাড়াও বিগত সময়ে প্রভাবশালী এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা আরো কর্মকর্তার নাম তালিকায় রয়েছে। তাদেরও গ্রেফতারের জন্য ধাপে ধাপে অনুমতি নেয়া হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বলেন, ফৌজদারি মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি পুলিশ সদস্যদের কয়েকজনকে গ্রেফতারের অনুমতি রয়েছে। যাদের পাওয়া যাচ্ছে, তাদের হেফাজতে নেয়া হচ্ছে।
সাবেক তিন আইজিপিসহ সারাদেশে এ পর্যন্ত পুলিশের ১৮৪ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে ডিএমপিরই ৯৯ জন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সারাদেশে এ পর্যন্ত সাবেক তিন আইজিপিসহ পুলিশের ১৮৪ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে ডিএমপির ৯৯ জন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র-গুলি লুট করা হয়। এসব ঘটনায় নিহত হন পুলিশের ৪৬ সদস্য। গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় কর্মবিরতিতে ছিল পুলিশ। পরে শীর্ষ পদসহ পুলিশের বিভিন্ন পদে রদবদল, বদলি করা হয়। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় বিভিন্ন পর্যায়ের ২৩ কর্মকর্তাকে। অনেক কর্মকর্তা এখনো কর্মস্থলে ফেরেননি। কেউ কেউ কর্মস্থলে যোগ দিয়েই ছুটিতে চলে গেছেন। ফলে এখনো পুরো সক্রিয় হয়ে ওঠেনি পুলিশ।
সূত্র: টিবিএস