২৩ মামলায় অজ্ঞাত আসামি অন্তত ৪০ হাজার # গত ১৬ দিনে এসব মামলায় ৫৮৩ জন গ্রেপ্তার # ২৩ মামলার এজাহারের একটিতেও নেই অস্ত্রধারী চার যুবকের নাম
ঢাকা অফিস।।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণকারী অস্ত্রধারী সেই চার যুবককে ১৫ দিনেও শনাক্ত করতে পারেনি নগর পুলিশ। গত ১৬ জুলাই বিকালে মুরাদপুর এলাকায় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবলীগ পরিচয়ধারী ওই চার যুবক। এতে এক শিক্ষার্থী ও এক পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। সেদিন আহত হন ৩০/৩৫ জন।
পুলিশ বলছে, অস্ত্রধারী সেই চার যুবককে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। তাদের শনাক্ত করতে সেদিনের বিভিন্ন সিসিটিভির ফুটেজ ও ভিডিও’র বিশ্লেষণ চলছে। শনাক্ত করা গেলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। নগর পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এ ব্যাপারে পুলিশ কাজ করছে। অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করা গেলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’
এদিকে ১৫ দিনেও চার অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করতে না পারায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ১৬ জুলাই বিকালে ছাত্রদের আন্দোলনে যে চার যুবক প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ করেছে তাদের ছবিসহ বিভিন্ন প্রতিবেদন অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি যা এক ধরণের ব্যর্থতা।
অপরদিকে যুগ ও চাহিদা অনুযায়ী কোটা সংস্কার আন্দোলন যৌক্তিক বলে মন্তব্য করে অপরাধ বিশ্লেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মানলাম কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে থানা-পুলিশ খুব ব্যস্ত। কিন্তু পুলিশের তো আরও ইউনিট আছে। গোয়েন্দা বিভাগ আছে। আন্দোলনে তো পুলিশের সব ইউনিট ব্যস্ত ছিল না। মুরাদপুরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণকারী চার যুবককে গেল ১৫ দিনেও পুলিশ কেন চিহ্নিত করতে পারল না সেটা আমি জানি না। সেদিন একজন শিক্ষাথী ও নিরীহ পথচারী কার বা কাদের গুলিতে মারা গেছে এসব প্রশ্নের উত্তর পুলিশকেই খুঁজে বের করতে হবে। এতদিনেও অস্ত্রধারীদের শনাক্ত না হওয়ার জন্য পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা দায়ী। আমি মনে করি এজন্য প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। তাহলে আসল সত্যটা বেরিয়ে আসবে।’
জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন যৌক্তিক বলে মন্তব্য করে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বৃহস্পতিবার বিকালে বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসন হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অর্গান। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাদের জুতার ফিতা পর্যন্ত জনগণের টাকায় কেনা। আন্দোলরত কোমলমতি ছাত্রদের দমনে সরকার দলীয় সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগই যথেষ্ট বলে উস্কানি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার উস্কানিতেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে। এটা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা কোমলমতি ছাত্রদের বুকে গুলি করে হত্যা করেছে। এসব নিউজ ছবি ভাইরাল হয়েছে। পুলিশ উল্টো তাদের প্রটেকশন দিয়েছে। মুরাদপুরে যারা গুলি করেছে তাদের ছবি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। অথচ পুলিশ চার অস্ত্রধারীকে ১৫ দিনেও শনাক্ত করতে পারল না। তাদের মামলার আসামিও করল না। ভবিষ্যতে এসবের বিচার হওয়া উচিত।’
জানা গেছে, ১৬ জুলাই বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশ মিছিল লক্ষ্য করে চার ব্যক্তিকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। সেদিন মুরাদপুর এলাকায় ছুরিকাঘাতে নিহত হন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম। গুলিতে নিহত এক শিক্ষার্থীসহ দুজন। আহত হয় অর্ধশতাধিক। গুলি করা সেই চার ব্যক্তির মধ্যে একজন মো. ফিরোজ। তিনি মহানগর যুবলীগের কর্মী। অন্যজন মো. দেলোয়ার। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সংগঠক। যুবলীগ নেতা পরিচয়ধারী ফিরোজ রিভলবার নিয়ে এবং দেলোয়ার শটগান নিয়ে গুলি করেন। বাকি দুজন অস্ত্রধারীর মধ্যে এইচ এম মিঠু ও মো. জাফর। এ দুজনও যুবলীগের কর্মী বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সেদিন (১৬ জুলাই) এ দুজনকে রিভলবার নিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। অস্ত্র উঁচিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করার দৃশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ জুলাই থেকে বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) পর্যন্ত কোটা সংস্কার অন্দোলন ঘিরে ‘নাশকতার’ অভিযোগে নগরের বিভিন্ন থানায় ২৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। এতে অজ্ঞাত আসামি অন্তত ৪০ হাজার। আজ ১ আগস্ট পর্যন্ত গত ১৬ দিনে এসব মামলায় ৫৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নগরে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫ জন। কিন্তু দায়ের হওয়া ২৩ মামলার এজাহারের একটিতেও নেই অস্ত্রধারী সেই চার যুবকের নাম। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সিএমপির সূত্র বলছে সেদিন আন্দোলনকারীদের দমন করতে পুলিশ কোনো অ্যাকশনেও যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ জুলাই বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে নগরের মুরাদপুর এলাকায় এবং এর দুই দিন পর ১৮ জুলাই বিকালে নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। পৃথক সংঘর্ষের এই ঘটনায় চারজন শিক্ষার্থীসহ ৬ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক। নিহতদের মধ্যে দুজন নিরীহ পথচারী রয়েছে।
১৬ জুলাই মুরাদপুর এলাকায় অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে মারা যান নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২৪) এবং একইদিন ছুরিকাঘাতে মারা যান চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক কক্সবাজার পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা গ্রামের শফিউল আলমের ছেলে ওয়াসিম আকরাম (২৩)। একইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নগরের শুলকবহর এলাকার ফার্ণিচার দোকানের কর্মচারী মো. ওমর ফারুক।
সুত্র: দেশ রূপান্তর