স্পোর্টস ডেস্ক||
স্পেন ফুটবল আর টিকিটাকা গত দেড় যুগে সমার্থক শব্দ হয়ে যায়। এতে এক সময় সাফল্য মিললেও এরপর ব্যর্থতা জেকে বসেছিল। সেটা থেকে উদ্ধার করতেই যেন লুইস দে লা ফুয়েন্তের আবির্ভাব। যার হাত ধরে পুরো স্পেন দলের খোলনোলচই বদলে যায়। টিকিটাকার সঙ্গে নতুন ধারার আক্রমণাত্মক ফুটবল দিয়ে এবার ইউরোই জিতে গেল স্প্যানিশরা। তাতে এক যুগ পর ইউরোর শিরোপা ঘরে গেলো টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ৪ বারের চ্যাম্পিয়নদের।
রোববার রাতে বার্লিনে ইউরোর ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারায় স্পেন। নিকো উইলিয়ামসের গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ইংল্যান্ডকে সমতায় ফেরান কোল পালমার। তবে শেষদিকে তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে ব্যবধান গড়ে দেন মিকেল ওইয়ারসাবাল। ৮৬তম মিনিটে গোল আদায় করেন তিনি। ম্যাচসেরা হন নিকো উইলিয়ামস।
এতদিন সর্বোচ্চ ইউরো জয়ের রেকর্ড ছিল যৌথভাবে স্পেন ও জার্মানির।
গতিময় ও নান্দনিক ফুটবলের পসরা মেলে চতুর্থবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেটা নিজের করে নিলো স্প্যানিশরা।
এবারের ইউরো শুরুর আগে শিরোপা জয়ের দৌড়ে স্পেনের নাম খুব একটা শোনা যায়নি। ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো কোনো বড় তারকাও ছিল দলটিতে। তবে একদম তারুণ্য নির্ভর দল স্পেন প্রথম ম্যাচেই নজর কাড়ে সবার। ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে হারানোর ম্যাচে আক্রমণাত্মক ফুটবল দিয়ে বার্তা দেয় সবাইকে। কয়েকদিন আগেও ধীর ফুটবল খেলার জন্য সমালোচিত হওয়া স্পেনই ফুটবলপ্রেমীদের জন্য আকর্ষনীয় দল হয়ে ওঠে।
গ্রুপ পর্বে টানা ৩ জয়ের পর নকআউটে জর্জিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্সকেও হারায় তারা। এরপর ফাইনালে তাদের শিকার হয় ইংল্যান্ড। স্পেনের এই সাফল্যের পিছনে আছেন লুইস ফুয়েন্তে, দলটির কোচ। ইউরো শুরুর আগে হয়তো অনেকে তার নামও জানতেন না। স্পেনের বাস্ক প্রদেশে বেড়ে ওঠা ফুয়েন্তের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় অ্যাটলেটিকো বিলবাওতে। দলটিতে খেলেন টানা ১১ বছর, ওদের হয়ে ১৯৮৮ সালে লীগও জেতেন তিনি। লেফট ব্যাক পজিশনে খেলা ফুয়েন্তে কখনও গায়ে জড়াতে পারেননি স্পেনের জার্সি। কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন একটি প্রাদেশিক দলে। ১৯৯৭ সালে কোচ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ২০১১ পর্যন্ত ৭টি দলে কাজ করলেও কখনও চুক্তি সম্পন্ন করতে পারেননি তিনি।
২০১৩ সালে স্পেনের অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে কোচিং করিয়ে মূলত ফোকাসে আসেন ফুয়েন্তে। এরপর অনূর্ধ্ব-২১ ও ২৩ দলের সঙ্গেও কাজ করেন তিনি। এই কারণে বর্তমান স্পেন দলে থাকা তরুণ ফুটবলারদের বেশিরভাগকেই তার চেনা। বলা ভালো তার হাতেই গড়ে উঠেছেন অনেকে। রদ্রি, উনাই সিমন ও মিকেল মেরিনোরা তার অধীনেই অনূর্ধ্ব-১৯ ইউরো জেতেন। এরপর অনূর্ধ্ব-২১ তার অধীনে খেলেন ফাবিয়ান রুইজ, দানি ওলমো ও মিকেল ওয়াইরজাবাল। ফেরান তোরেস, কুকুরেইয়া ও পেদ্রির মতো খেলোয়াড়রাও বেড়ে ওঠার সময় ফুয়েন্তের অধীনে ছিলেন। ফলে ফুয়েন্তে তাদের কাছে বাবার মতোই।
এরপর ২০২২ বিশ্বকাপে ব্যর্থতায় ফুয়েন্তের হাতে জাতীয় দল তুলে দেয় স্পেন রয়্যাল ফুটবল ফেডারেশন। তবে সার্জিও রামোসকে না ফেরানোয় শুরুতেই সমালোচনার শিকার হন। স্প্যানিশ মিডিয়ায় গুঞ্জন ছিল, বড় কোনো কোচ পেলে তাকে সরিয়ে দিতে পারেন ফেডারেশন। তবে কয়েক মাসের মধ্যে স্পেন নেশন্স লীগ জিতে গেলে পরিস্থিতি বদলানো শুরু করে।
ফুয়েন্তে শুরুতেই দলকে পরিবার বানিয়েছেন। বিতর্ক তৈরি করলেই বাদ দিয়েছেন দল থেকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্যাম্পে এল ক্লাসিকো নিয়ে গাভির সঙ্গে ঝগড়া করায় দল থেকে বের করে দেন সেবায়স্কোকে।
দল তৈরিতে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের বিকল্প রেখেছেন ফুয়েন্তে। অধিনায়ক নাম্বার নাইন আলভারো মোরাতার বিকল্প হোসেলু, ফুলব্যাক কুকুরেইয়ার বিকল্প গ্রিমাল্ডো, উইঙ্গার নিকো উইলিয়ামসের ব্যাকআপ হিসেবে রাখেন ফেরান তোরেসকে। এতে করে যখনই পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়েছে তিনি সেটা সহজেই করতে পেরেছেন।
স্পেন দলে ফুয়েন্তে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটান খেলার কৌশল বদলে। দীর্ঘদিন ধরে এক কৌশলে খেলা দলের জন্য এটা যথেষ্ট ঝুকিপূর্ন কাজ। গত প্রায় দেড় যুগ ধরে টিকিটাকা স্টাইলে খেলা স্পেনকে স্বত্তা ধরে রেখে কৌশল বদলেছেন। ইনভারটেড উইঙ্গারদের বাইরে রেখে ট্রাডিশনাল উইঙ্গার খেলানো শুরু করেন তিনি। যেখানে নিকো আর ইয়ামালরা সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করেন। যারা প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের ড্রিবল করেও এগোতে পারেন আবার পিছনে দৌড়ে বল কেড়েও নিতে পারেন। এছাড়া অনেক সময় নিজস্ব মুভ দিয়ে ডিফেন্ডারদের তাদের দিকে আটকে রাখেন। এতে করে বাকিদের জন্য স্পেস তৈরী হয়। যেটি কাজে লাগান ফুলব্যাকরা। ফাইনালে একটি গোল এমন হয়েছে। ম্যাচের ৪৬তম মিনিটে ডান উইং ধরে শাণানো আক্রমণে সতীর্থের বল পেয়ে একটু এগিয়ে বক্সে অন্য পাশে উইলিয়ামসকে খুঁজে নেন ইয়ামাল। আর বিনা বাধায় দারুণ কোনাকুনি শটে লক্ষ্যভেদ করেন আথলেতিক বিলবাও ফরোয়ার্ড।
এই আসরে অবশ্য জার্মানির বিপক্ষে পেদ্রি চোট পাওয়ায় সুযোগ পান অলমো। এতে করে স্পেনের মিডফিল্ড আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। আর আক্রমণও আসে বেশি। তবে প্রয়োজনে টিকিটাকাতেও ফিরতে পারেন ফুয়েন্তা। যার প্রমাণ ফ্রান্সের বিপক্ষে শেষ ১০ মিনিট!