স্টাফ রিপোর্টার
প্রায় ১০ বছর ধরে নিজের ৫ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করতেন কয়রা উপজেলার চরামুখা গ্রামের আলমগীর হোসেন। বেড়িবাঁধের নিচে পাইপ বসিয়ে ঘেরে লবণ পানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ করতেন তিনি। কিন্তু চলতি বছর বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় সেই পাইপ অপসারণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে বন্ধ হয়ে গেছে ওই এলাকার সব চিংড়ি ঘের।
আলমগীর হোসেন বলেন, আগে জমিতে বছরে একবার আমন ধান চাষ করতাম। কিন্তু মাটিতে লবণাক্ততার কারণে ধান উৎপাদন ভালো হতো না। সে কারণে চিংড়ি চাষ শুরু করি এবং ভালো লাভ হতো। কিন্তু এখন চিংড়ি চাষ করতে না পারায় কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। এ গ্রামের অর্ধশত চিংড়ি চাষি বেকার হয়ে পড়েছেন।
পার্শ্ববর্তী মাটিয়াভাঙ্গা গ্রামের মঞ্জুর আলম বলেন, এখন আর ঘেরে লবণ পানি তুলতে পারছি না। ফলে চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়ে গেছে। আর জমি যে পরিমাণ লবণাক্ত তাতে ধান বা অন্য ফসলও ভালো হয় না। আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। জমিও পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। বিকল্প কোনো উপায়ও দেখছি না।
শুধু এ দুটি গ্রামেই নয়, খুলনার ৯টি উপজেলায় লবণ পানি তুলতে না পারায় অনেক চাষি চিংড়ি চাষ করতে পারছে না। আবার অনেকে স্বেচ্ছায় চিংড়ি চাষ ছেড়ে ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষ করছে। পুঁজি সংকট, ভাইরাস ও দাবদাহে চিংড়ির মড়কের কারণে অনেকে চিংড়ি চাষ ছেড়ে দিয়েছে। কয়েকটি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় লবণ পানি পাচ্ছে না চাষিরা। এছাড়া চিংড়ি ঘেরের বেশ কিছু জমিতে ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। এ অবস্থায় খুলনা জেলায় চিংড়ি চাষ কমে গেছে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। সে কারণে কমেছে চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানির পরিমাণ।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জেলায় মিষ্টি পানির গলদা চিংড়ির ঘের ছিল ২০ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৫৮৪ মেট্রিক টন। চলতি অর্থ বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাষের জমি কমেছে ১ হাজার ১৮ হেক্টর এবং চিংড়ি উৎপাদন কমেছে ২ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জেলায় লবণ পানির বাগদা চিংড়ির ঘের ছিল ৩৬ হাজার ১৫১ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন। চলতি অর্থ বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ২৬৪ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাষের জমি কমেছে ৩ হাজার ৭৬৮ হেক্টর এবং চিংড়ি উৎপাদন কমেছে ১ হাজার ৩২৬ মেট্রিক টন। গত ৫ বছরের ব্যবধানে বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের কমেছে ৪ হাজার ৭৮৬ হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন কমেছে ৩ হাজার ৭৫২ মেট্রিক টন।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, খুলনার হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী গলদা ও বাগদা চিংড়ি পাচ্ছে না। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল, শ্রমিকদের-কর্মচারীদের মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয় একই রকম রয়েছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে পড়ছে।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, ঘেরে লবণ পানি তুলতে না পারা, নদী ভরাট, নতুন নতুন ঘরবাড়ি গড়ে ওঠা, পুঁজি সংকট, চিংড়ির মড়কসহ বিভিন্ন কারণে খুলনায় আগের তুলনায় কম জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। সেই সঙ্গে উৎপাদন ও রপ্তানির পরিমাণ কমে গেছে।
তিনি আরও জানান, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত না করে স্লুইস গেট, রেগুলেটর বা অন্য কোনো উপায়ে জোয়ারের স্বাভাবিক প্রবাহ দ্বারা লবণ পানি উঠানো অব্যাহত রেখে চিংড়ি চাষ করা যাবে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকায় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি তুলতে বাধা দিচ্ছেন। তাদেরকে বিষয়টি বুঝিয়ে সংকট নিরসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ লবণাক্ত অনেক জমি আছে যেখানে কোনো কৃষি ফসলই ভালো হয় না। এছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য আলাদা জোন নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
চলতি বছরের মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা। এই ক্ষতি বাড়িয়ে দিয়েছে বেড়িবাঁধের ভাঙন। খুলনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরাসহ উপকূলের বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি হয়ে আছেন।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, এই জেলার ৪৬.৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, ঝড়ের সময় খুলনার ৫৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে এবং জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার বাড়িঘর। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ। এছাড়া ফসলের মাঠ, ঘের-পুকুর নোনা পানিতে ভেসে গেছে।
এদিকে আরেক উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় ৩৬.৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে নোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। নষ্ট হচ্ছে ফসল। ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাকসুদুল আলম জানান, রেমালের সময় নদ-নদীতে ৫ থেকে ৭ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের মালিবাড়ির দৃষ্টিনন্দন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। ওই বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানির তোড়ে ধসে পড়ে। এতে আতঙ্কে রয়েছেন ইউনিয়নের সোরা, ডুমুরিয়া গ্রামসহ পাশের কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষ। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান এই জনপ্রতিনিধি।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে জেলার উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট এখনও কাটেনি। জেলা প্রশাসনের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ২৭টি খাতে ৬৪৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য খাতগুলো হচ্ছে- কৃষি, মৎস্য, বিদ্যুৎ, সড়ক, পানি, বন, নৌকা-জাল ও ট্রলার।
ইতোমধ্যে রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ তন্ময়। তিনি বাগেরহাট ভৈরব নদী পাড়ের ভাঙন কবলিত ক্ষতিগ্রস্ত স্থান পরিদর্শন করেন। এ সময় শেখ তন্ময় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খোঁজখবর নেন। এছাড়া ভৈরব নদীর গোপালকাঠি, কেশবপুর, কুলিয়াদাইড় এলাকার ভাঙন কবলিত নদীর তীর রক্ষাবাঁধের জাইকার অর্থায়নে চলমান কাজ পরিদর্শন করেন।
রেমালে বরিশাল বিভাগেও ক্ষতি হয়েছে বাঁধের। বরিশালের ১৪টি পয়েন্টে এক কিলোমিটার, ভোলায় ১০ কিলোমিটার, বরগুনায় ১২ কিলোমিটার, পটুয়াখালীতে ৫০ কিলোমিটার আংশিক আর ২.৫ কিলোমিটার পুরোপুরি, পিরোজপুরে ১০ কিলোমিটার এবং ঝালকাঠিতে ৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রেমালে ভোলার মনপুরা উপজেলায় আড়াই হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ঘরবাড়ি হারিয়েছে চার শতাধিক পরিবার কিন্তু বিধস্ত বেড়িবাঁধগুলোর সংস্কার হয়নি। এতে এখনও পুরোপুরি অরক্ষিত মনপুরা। দীর্ঘসময় নোনা জলে প্লাবিত হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটছে বাসিন্দাদের। হুমকির মুখে পড়েছে আমনের চাষাবাদ।
দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অলিউল্যাহ কাজল অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে কাজ শুরুতে বিলম্ব করায় এমন দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধ দ্রুত সংস্কার করতে না পারলে এবার আমন চাষ করা যাবে না। অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে গ্রাম প্লাবিত হবে।
রেমালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মনপুরার কলাতলীর চর ইউনিয়নে। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলউদ্দিন হাওলাদার জানান, ২৫ হাজার মানুষের বসতির এ ইউনিয়নে কোনো বেড়িবাঁধ নেই । তাই জোয়ার-ভাটা থেকে রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।