খুলনাঞ্চল রিপোর্টার।।
জ্যোৎস্না বেগম। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। তবুও হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে। রোদের জন্য তাকানো যাচ্ছিলো না কর্ণফুলী নদীর দিকে। তারপরও এক হাত কপালে নিয়ে ছেলে তানভীর আহমেদের জাহাজ খুঁজছেন জ্যোৎস্না বেগম। তানভীর এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী। জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়া সেই ২৩ নাবিকের একজন তিনি। তাকে বরণ করতেই এমন ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় মা। মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে এসেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তানভীর নামছেন জাহাজ থেকে। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন মাকে।
ফুল দিয়ে মা জ্যোৎস্না বেগম যখন ছেলেকে বরণ করছিলেন, তখন ছলছল করছিল তানভীরের স্ত্রীর চোখ। ২৩ নাবিককে কাছে পেয়ে আজ এমনই আবেগ আপ্লুত ছিলেন তাদের স্বজনরা। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটি সাক্ষী হয়েছে অনেক আনন্দ অশ্রুর।
জিম্মি দশা থেকে এক মাস আগে মুক্ত হলেও এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে থাকা ২৩ নাবিক আজই স্বজনদের দেখা পেয়েছে। এনসিটি জেটিতে নাবিকদের বরণ করে নেয় তাদের স্বজনরা। সংবর্ধনা দিয়েছে তাদের বন্দর কর্তৃপক্ষও।
এদিকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নাবিকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সশরীরে এসে নাবিকদের সাহস দিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল।
সংবর্ধনার জন্য ছোট্ট একটি ছাউনি তৈরি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নাবিকদের মন পড়েছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ৪০ হাত দূরে, যেখানে অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনরা।
সেখানেই দেখা হয় নাবিক নুরউদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের সঙ্গে। স্বামী নুরউদ্দিনের হাতে হাত রেখে অঝোরে কাঁদছেন তিনি।
নুরউদ্দিন বললেন, ওই ঘটনার পর মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত ছিলাম আমি। এখন কিছুটা ভালো আছি। কিন্তু দুঃসহ সেই স্মৃতি, ভুলতে পারছি না।
পাশে দাঁড়ানো জ্যোৎস্না বেগম বললেন, গত দুই মাস যে আমাদের কেমন গেছে তা বলে বোঝাতে পারব না। এবার আমাদের কোনো ঈদ ছিল না। আজই যেন আমাদের ঈদ।
কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম বলেন, গত ২৮ এপ্রিল দুবাই থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা জাহাজটি কুতুবদিয়া চ্যানেলে আছে। বিকল্প একটি টিম দেওয়া হয়েছে সেই জাহাজে। আর জাহাজে থাকা ২৩ নাবিক চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে নেমেছে আজ বিকেল ৪ টায়। এনসিটি জেটিতে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাতে বাড়ি ফিরে যাবেন তারা।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি দুবাই থেকে ৫৬ হাজার টন চুনাপাথর নিয়ে চট্টগ্রামে এসেছে। কুতুবদিয়া চ্যানেলে লাইটারেজ জাহাজ লাগিয়ে সেগুলোর কিছু অংশ খালাস করা হবে। বাকি চুনাপাথর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এনে খালাস করবে জাহাজটি।
গত ১৩ এপ্রিল ভোর ৩টায় সোমালিয়ার দস্যুদের কাছ থেকে ২৩ নাবিকসহ মুক্তি পায় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ। দস্যুদের ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি মুক্ত হয়েছে বলে আলোচনা আছে। যদিও টাকার এই অঙ্ক স্বীকার করেনি জাহাজটির মালিকপক্ষ। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাচ্ছিল। এটি ছিনতাইয়ের পর সোমালিয়ার উত্তরপূর্ব উপকূলের গ্যরাকাদে নোঙর করেছিল। এর আগে একই মালিক গ্রুপের এমভি জাহান মনিকে নাবিকসহ ২০১০ সালে জিম্মি করেছিল জলদস্যুরা। সে সময়ও মুক্তিপণ দিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়।