কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রেৃ’ এ গানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে গগন হরকরার নাম। শুধু তাই নয়, ওই গান থেকে সুর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা গান লিখেছেন। সেই গানই এখন আমাদের জাতীয় সংগীত। অর্থাৎ জাতীয় সংগীতের সুরকারও তিনি। এই বাউল কবি ও গায়ক গগন হরকরা নামে পরিচিত হলেও তার পারিবারিক নাম গগন চন্দ্র দাস। শিলাইদহের পোস্ট-অফিসে ডাক-হরকরার কাজ করতেন। তাই এ পেশার সুবাদেই তিনি লোকের কাছে ‘গগন হরকরা’ নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
এই লোক কবির মৃত্যুর শত বছরেরও বেশি সময় পরে এসে তার স্মৃতি রক্ষার্থে একটা ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। যেটির অবস্থান কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন বেলগাছী মোড়ে। এটি উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ।
নীল আকাশের নিচে খোলা প্রান্তরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই ম্যুরালের গায়ে ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রেৃ’ গানটি খোদায় করে দেয়া হয়েছে। এর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকারী কুমারখালী উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মন্ডল।
তার কাছে এ শিল্পকর্মের থিম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জানান, ম্যুরালের বুকের ওপর একতারা তার শিল্পীসত্তার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে হাতে লণ্ঠন ও বল্লম এবং পিঠে চিঠি বহন করা ব্যাগ তার পেশাকে নির্দেশ করছে।
কুমারখালীর বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল হক বলেন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির উর্বর ভূমি কুষ্টিয়া। রঙে রসে সমৃদ্ধ প্রাচীনতম এ জেলার রয়েছে দিগন্ত জোড়া সৌন্দর্য। প্রকৃতির রঙ আর অসংখ্য গুণীজন রয়েছে এই নগরীতে। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গৌরবময় সাহিত্য চর্চার আলো ছড়ায় এ জেলা।
বাউল শিল্পীর অবয়ব দিয়ে গড়া ম্যুরালের সামনে মিন্টু আহম্মেদ নামের এক দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা হয়। রাজশাহী থেকে এসেছেন। শিলাইদহের কুঠিবাড়ী থেকে ফিরছেন। দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছেন তিনি। অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে এই দর্শনার্থী বলেন, ‘বইপুস্তকে গগন হরকরার নাম অনেকে পড়েছেন। কিন্তু ম্যুরালটি এখানে স্থাপন করায় মানুষ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ী যেতে-আসতে গগন হরকরাকে জানতে পারবে।’
আনুমানিক ১৮৪৫ সালে তৎকালীন পাবনা জেলার গোবরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই বাউলশিল্পী। যদিও এ গ্রামটি এখন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রাম নামে পরিচিত। তিনি কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি তৎকালীন শিলাইদহের ডাকঘরের ডাক হরকরার চাকরি করতেন।
ম্যুরাল চত্বর থেকে ঘুরে গগন হরকরার জন্মস্থান গোবরাখালী গ্রামে গিয়ে তার ভিটেমাটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে লোকমুখে জানা যায়, ‘দুই যুগ আগেও গগনের ভিটা ও ফলের বাগানের অস্তিত্ব ছিল। শিলাইদহে গগন হরকরার একটি বড় ফলের বাগান ছিল এবং গগনের বাস্তভিটায় আসামদ্দি নামক একজন কৃষক বাড়ি করে থাকতেন।’
গগন হরকরার পিতা-মাতা সম্বন্ধে তেমন তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে তার এক ছেলের নাম কিরণ চন্দ্র।
শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়া শহরে ফেরার পথে নিশান মোড়ে এসে চোখে পড়বে পিতল দিয়ে গড়া এক ভাস্কর্য। বাম হাতে হারিকেন ও বল্লম। বল্লমের আগার নিচে একটি ছোট ঘণ্টা। ডান হাতে লাঠির মাথায় কাঁধে রাখা চিঠির বস্তা। মাথায় পাগড়ি, পরনে ধুতি। রাতের আঁধার ভেদ করে ছুটে চলেছেন সামনের দিকে। ২০১৬ পৌর কর্তৃপক্ষ এটি নির্মাণ করেছে।
আনুমানিক ১৯১০ সালে পরলোকগমন করেন এই গুণী বাউল কবি ও শিল্পী।
লেখক ও গবেষক গৌতম কুমার রায়ের মতে, বাউলদের আত্মা দুই পর্যায়ের। পরমাত্মা ও জীবাত্মা। তবে জীবাত্মা হলো পরমাত্মার অংশ বিশেষ। যা মানুষের দেহভান্ডারে থাকে। গগন দেহ চর্চার মাধ্যমে ভগবৎ শক্তির সন্ধানে নেমে সৃষ্টি করেন ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রেৃ।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহতি এই মানুষটাকে মূল্যায়ন করে গেছেন।