ঢাকা অফিস।।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবন। এ ভবনের পঞ্চম থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত প্রতিটি তলায় ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। ওয়ার্ড ছাড়িয়ে রোগীদের জায়গা হয়েছে খোলা জায়গার মেঝেতে, সিঁড়ির খোলা অংশে, বাথরুমের পাশে। রোগীদের জন্য নেই মশারি, প্রত্যেক রোগী খোলা আকাশের মতো খোলা ছাদের নিচে শুয়ে আছেন।
বাগেরহাট থেকে ঈদের ছুটিতে চাচার ঢাকার মিরপুর-২ নম্বরের বাসায় এসেছিল সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শিমু। গত পাঁচ-ছয় দিন ধরে জ্বর, পাতলা পায়খানা, বমি ছিল। শনিবার রাতে পরীক্ষার পর শিমুর ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাপসাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চম তলার ফ্লোরে শিমুর এক হাতে স্যালাইন বাঁধা, আরেক হাত ধরে রেখেছেন মা।
শিমুর চাচা খান মোহাম্মদ জাকির হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, শিমুর মা ছিলেন বাড়িতে। কিন্তু মেয়ের এ অবস্থার কথা শুনে রাতেই রওনা হয়ে ঢাকায় এসেছেন। তিনি বলেন, আনন্দ করতে ঢাকায় এসেছিল শিমু, কিন্তু এ অবস্থায় পড়বে জানলে মেয়েকে আসতে দিতেন না। জাকির হোসেন বলেন, মিরপুরের মণিপুরে মশার ওষুধ ছিটাতে কখনো দেখিনি। এ নিয়ে আক্ষেপ আর ক্ষোভের কথা জানালেন তিনি।
বিক্রমপুর থেকে এসেছেন ২০ বছরের হাফসা। ছয়-সাত দিন ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গত পরশু। কিন্তু শিমুর মতো হাফসাও একটি বেডও পাননি। ফ্লোরে শুয়ে আছেন, হাতে ঝুলছে স্যালাইন। আরেক পাশে বসে তার ভাবি কাগজ দিয়ে বাতাস করছেন।
তবে রোববার রাতের চাইতে আজ অবস্থা একটু ভালো জানিয়ে ভাবি সুমাইয়া বলেন, এসব রোগীর জন্য একটা বেডের ব্যবস্থা করতে পারে না হাসপাতাল। একটা স্যালাইন লাগানো কেবল, কোনো কেয়ার নেই। মশারি নেই… যেভাবে এখানে ফ্লোরে রোগীদের রাখা হচ্ছে- এটা তো নিয়ম না। ডেঙ্গু রোগীদের মশারির ভেতর রাখতে হয়, কিন্তু একটা রোগীর জন্যও মশারি নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, মশারি দেবে কী, বেড নেই, ফ্লোরে পা ফেলার জায়গাও নেই।
দেশের সবচেয়ে বড় এই সরকারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সারা দেশ থেকে রোগীরা আসছেন। এখানেই কেবল নির্ধারিত শয্যার বিপরীতেও রোগী ভর্তি রাখা হয়, এর যুক্তি হচ্ছে এই হাসপাতাল থেকে কাউকে ফেরানো হয় না, অন্তত তারা যেন চিকিৎসা পান। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার অন্যতম শর্তই হচ্ছে তাদের মশারির ভেতর রাখতে হবে। কিন্তু সেটি এখানে করা হচ্ছে না- আর এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাসপাতালেরই চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এভাবে চিকিৎসা দিয়ে সঠিকভাবে ডেঙ্গু চিকিৎসার গাইডলাইন মানা সম্ভব হচ্ছে না।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী ২ ঘণ্টা পরপর তাদের ফলোআপ করতে হবে, কিন্তু যে পরিমাণ চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন তাদের পক্ষে এটি সম্ভব হচ্ছে না। সিঁড়িতে যে রোগী থাকছেন, সে তো এমনিতেই ‘হাইপো ভলিউমিক শকে (অক্সিজেনের অভাব)’ গিয়ে তার মৃত্যু হবে।
জুলাই মাস শুরু হয়েছে। কখনো থেমে থেমে, কখনো একটানা বৃষ্টির এই সময় শুরু হলে ডেঙ্গুতে রোগী আরও বাড়ার শঙ্কা ছিল। সে শঙ্কার চূড়ান্ত রূপ দেখা যাচ্ছে দুই দিন ধরে। দেশে টানা দুই দিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ৮০০-এর বেশি রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আগের দিনের রেকর্ডসংখ্যক রোগীকে পেছনে ফেলে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর নতুন রেকর্ড হয়েছে। আর এ সময়ে আগের মৃত্যুর রেকর্ডকেও পেছনে ফেলেছে।
অধিদপ্তর রোববার জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (৮ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৯ জুলাই সকাল ৮টা) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৩৬ জন। আগের দিন (৮ জুলাই) ৮২০ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ছয়জনের- চলতি বছরে এক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে গত ৪ জুলাই এক দিনে পাঁচজনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল অধিদপ্তর।
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ৯৫৪ জন আর এখন পর্যন্ত মৃত্যু হলো ৭৩ জনের।
চলতি বছরের মোট রোগীর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ৯ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৯৭৬ জন আর এ মাসে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের।
গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। আর মৃত্যু হয় ২৮১ জনের। দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এটিই সর্বোচ্চ।
তবে ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পর সবচেয়ে বেশি রোগী হাপসাতালে ভর্তি হন ২০১৯ সালে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। আর সে বছরে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৭৭৪ জন আর বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ৪১৪ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫১ জন আর বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ২২১ জন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলেন, ‘ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বর্তমানে ধর্মঘট করছে। অথচ একটি হাসপাতালের মূল চালিকাশক্তিই তারা, হাসপাতালের ৮০ শতাংশ চিকিৎসা চলে তাদের মাধ্যমে। আর এ অবস্থায় রোগীদের সঠিক চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে এক দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘শুরুর দিকে নির্ধারিত ওয়ার্ড করেছিলাম, এরপর রোগী বাড়াতে আরেকটি ওয়ার্ড করা হয়েছে। এখন আরও বেড বাড়াতে হবে।’
এদিকে দেশে এরই মধ্যে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৫৭টি জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী আছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রোগী সবচেয়ে বেশি। যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, তার ৬০ শতাংশই ঢাকায়।
গত বছর এ সময় ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেক ভালো ছিল উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, এ বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। সামনের দুই থেকে তিন মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বেশি বাড়তে পারে। কারণ আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। এরই মধ্যে ডেঙ্গু অনেক বেড়েছে। সজাগ না হলে আরও বেড়ে যাবে। সবাই মিলে কাজ করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই না, একটি লোকও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করুক। যারা একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। কাজেই এদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। দেশের সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট করা হয়েছে। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া আছে। স্যালাইনসহ যেসব ওষুধ প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎসায় কোনো সমস্যা নেই।’