ড. লীনা তাপসী খান।।
কবি নজরুল ও বাংলাদেশ নিয়ে বলতে গেলে কবি নজরুলের সমস্ত লেখার মধ্যেই পরস্ফুটিত রয়েছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের স্বপ্ন। কাজী নজরুল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক কালজয়ী কবি। বাংলা আধুনিক গানে বুলবুল ও বাংলা সাহিত্যে তিনি বিদ্রোহী কবি নামে খ্যাত। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মুক্তির গান। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিণী ও গজল সৃষ্টি করে বাংলা সংগীতজগেক সমৃদ্ধ করেছেন। তার লেখা বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করেছে।
কবি নজরুলের লেখা প্রচলিত ধারা থেকে আলাদা ছিল। কবি তার লেখায় সার্থক সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন সংস্কৃত-আরবি-ফারসি শব্দের। শব্দের এমন স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল প্রয়োগ শুধু বাংলা সাহিত্যকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে তা নয়, বাংলা ভাষার ধারণক্ষমতা ও আন্তর্জাতিকতার প্রমাণও এতে রয়েছে। নজরুলের ক্ষুরধার লেখনীর স্ফুলিঙ্গ যেমন ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়েছে, তেমনি তার বাণী ও সুরের অমিয় ঝরনাধারায় সিঞ্চিত করেছে বাঙালির হৃদয়ে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবির গগণভেদী উচ্চারণ ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য’। তিনি প্রেমের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। তিনি ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান করেছেন। নারীর অধিকারকেও করেছেন সমুন্নত। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও সৃজনশীল কর্ম বাঙালির অন্তহীন প্রেরণার উৎস। তিনি তার লেখার জন্য গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছেন, মামলার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন, এমনকি তার বেশ কিছু লেখা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। জেলে বসেও রাজবন্দিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য অনশন করেছেন। পরাধীন দেশে বাস করেও তার লেখায় ও সৃষ্টিকর্মে পরাধীনতা স্পর্শ করেনি। নজরুল স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন। তার লেখার এই আপসহীন চেতনা ও প্রেরণা বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার মানসিকতা তৈরির এক নতুন মাইলফলক।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্বাধীন চিন্তাচেতনার জন্য অন্যতম কবি নজরুল। সৃষ্টির ভুবনে তিনি ছিলেন স্বাধীন। বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমির কথা তিনিই চিন্তা করেছিলেন প্রথম। ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের ৩ বৈশাখ ‘নবযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধের তিনি লিখেছেন,
‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছোটবেলা থেকে শুধু এক মন্ত্র শেখাও—
এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির-আমাদের।
বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’
আর সেজন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও ঐতিহাসিক স্বাধীন সত্তার রূপকার।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্রই ছিল জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবির এই আহ্বান এবং এই আশাবাদ থেকে ‘জয় বাংলা’ চয়ন করেছিলেন।
কবির প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ও ভালোবাসা থেকে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাকে নিয়ে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। কবি ও কবির পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু নিজে নিয়েছিলেন। বিশ দশকের প্রতিনিধি নজরুল ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, রক্ষণশীলতা, আঞ্চলিকতা, গোঁড়ামি, মানুষের ওপর মানুষের নির্যাতন-শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। নজরুলই একমাত্র কবি, যিনি বুঝতে পেরেছিলেন উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বড় সমস্যা। তাই তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব ধর্মের মিলন কামনা করে কবিতা ও গান রচনা করেছেন। তাই তো তিনি ‘সাম্যবাদী’ কাব্যে বলেছেন :
‘গাহি সাম্যের গান—
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান।’
কবি ১৯১৪ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বহুবার বাংলায় এসেছেন—বরিশাল, কুমিল্লা, দৌলতপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, রাউজান, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে। নজরুলের সংগ্রামী জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। কবি কুসংস্কারে আবদ্ধ বাঙালি জাতিকে জাগরণের আহ্বান জানালেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিরামহীন লড়াই ও শোষণমুক্ত বঞ্চনা-নিপীড়নমুক্ত একটি আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টা ও তার রচনায় পাওয়া যায়। তাই শুধু ভাষা-সংস্কৃতি নয়, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমাদের প্রাণিত করে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে। তার লেখার ঝলক থেকে বাঙালির প্রতিবাদী চেতনার পদযাত্রা। তাই বাংলাদেশ সৃষ্টির মহান স্থপতি জাতির পিতা মনে করতেন জন্ম থেকে হৃদয়ে নজরুল স্বাধীন ছিলেন।
কবি নজরুল ব্যক্তিগত জীবনে কোনো দলেও যোগ দেননি বা সমর্থক ছিলেন না। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তৎকালীন ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজফ্ফর আহমদের সংস্পর্শে থেকেও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি। কবি নজরুল দার্শনিক বা সমাজতত্ত্ববিদ হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ না করলেও তার লেখা নারী, কুলি-মজুর, পাপ, ঈশ্বর, মানুষ, বারাঙ্গনা প্রভৃতি কবিতায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে মানবতত্ত্ব ও সাম্যবাদী চেতনা। তার যে বিদ্রোহী চেতনা, সেটা কোন নিয়মের বিরুদ্ধে তা সুস্পষ্ট হওয়া যায় তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। এসব কিছু বিশ্লেষণ করে নজরুলের লেখায় তার যে স্বাধীন চেতনা প্রকাশ পায়, আর এই স্বাধীন চেতনা পারিবারিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক সব স্বাধীনতারই এক শানিত উচ্চারণ ও পথপ্রদর্শক।
কবি নজরুল ইসলামের ‘বাংলাদেশ’ ও বাঙালির চেতনায় ‘বাংলা’—এ বিষয়টি স্বপ্ন থেকে বাস্তবায়নের সময় নিয়েছে ২৯ বছর, অর্থাৎ কবি বাকরুদ্ধ হয়েছিলেন ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে। কবি নজরুলের গানে আমরা বাংলাদেশ শব্দটি পাই নানাভাবে। তার একটি অপূর্ব গান :
‘এই আমাদের বাংলাদেশ
এই আমাদের বাংলাদেশ
যে দিকে চাই স্নিগ্ধ শ্যামল
চোখ জুড়ানো রূপ অশেষ।’
লেখক : নজরুল সংগীতশিল্পী ও সাবেক চেয়ারম্যান, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়