স্টাফ রিপোর্টার।।
খুলনা মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গভীর-অগভীর নলকূপ, সাধারণ পাম্প ও সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানি। প্রতিদিন ভূ-গর্ভ থেকে ৫ কোটি লিটারের বেশি পানি না তুলতে পরামর্শ দিয়েছিল এডিবি। কিন্তু পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর।
গত ৮ বছরের ব্যবধানে নগরীর ২১টি ওয়ার্ডে পানির স্তর নিচে নেমেছে ১ দশমিক ৪৭ মিটার থেকে ৪ দশমিক ২৪ মিটার (প্রায় ১৩ ফুট) পর্যন্ত। এর ফলে চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি উঠছে না অনেক নলকূপ ও পাম্পে।
খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন বাগেরহাটের মোল্লাহাট এলাকার মধুমতী নদীর ১১ কোটি লিটার পানি পরিশোধন করে খুলনা নগরীতে সরবরাহের জন্য একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ওয়াসা। ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়া এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু সক্ষমতা বেশি থাকলেও ওয়াসা এখন ওই প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরবরাহ করছে প্রায় ৫ কোটি লিটার পানি।
ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, ভূ-গর্ভ থেকে এখন ৪০টি পাম্পের মাধ্যমে প্রতিদিন ওয়াসা তুলছে ২ কোটি লিটার পানি। আর নগরবাসী ওয়াসার মালিকানাধীন প্রায় ৯ হাজার নলকূপ দিয়ে ২ কোটি লিটার এবং ব্যক্তিগত ১৪ হাজার নলকূপ ও সাধারণ পাম্প দিয়ে তুলছে প্রায় ৩ কোটি লিটার পানি।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে জরিপ চালিয়ে প্রতিদিন ভূ-গর্ভ থেকে ৫ কোটি লিটারের বেশি পানি না তুলতে পরামর্শ দিয়েছিল এডিবি। কিন্তু প্রায় ৭ কোটি লিটার পানি তোলায় নিচে নেমে গেছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর।
এদিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কতটি সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার হয় তার কোনো পরিসংখ্যান নেই ওয়াসার কাছে। পানি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন অ্যাওসেড এর জরিপ অনুযায়ী নগরীতে প্রায় ৩৫ হাজার সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন করা হয়। তবে কী পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয় তার পরিসংখ্যান নেই তাদের কাছে।
ওয়াসা প্রতি বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালায়। সংস্থাটির জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর ৯নং থেকে ৩১ নং ওয়ার্ডে (মোট ২১টি ওয়ার্ড, ১৫ ও ২২ নং ওয়ার্ডে করা হয়নি) ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে ১ দশমিক ৪৭ মিটার থেকে ৪ দশমিক ২৪ মিটার পর্যন্ত। ২০১৫ সালে নগরীর ২০ নং ওয়ার্ডে পানির স্তর পাওয়া যেতো ৭ দশমিক ৩৬ মিটারে। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬ মিটারে। অর্থাৎ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে প্রায় ৪ দশমিক ২৪ মিটার বা ১২ দশমিক ৭২ ফুট।
পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে অনেক নলকূপ ও পাম্প থেকে আর আগের মতো পানি উঠছে না। বিশেষ করে নগরীর শেখপাড়া, গোবরচাকা, বড় মির্জাপুর, ছোট মির্জাপুর, বাইতিপাড়াসহ আরও অনেক এলাকায় অগভীর নলকূপ থেকে একেবারেই পানি উঠছে না। এর ফলে বিপাকে পড়েছেন নগরবাসী।
নগরীর ২০ নং ওয়ার্ডের শেখপাড়া পুরাতন মসজিদের খাদেম হাফেজ জাকারিয়া হোসেন বলেন, আগে যে কোনো সময় পাম্প চালালে পানি উঠত। কিন্তু এপ্রিল মাস থেকে দুপুর বেলা পাম্প চালালে পানি ওঠে না। সন্ধ্যার পর ও ফজরের পর পাম্প চালাতে হয়।
ওই এলাকার বাসিন্দা হোসাইন আহমেদ সোহাগ বলেন, প্রতিবছর মার্চের শুরু থেকে নলকূপে পানি উঠত না। এজন্য সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করেছি। এলাকার যেসব বাড়ির নলকূপে পানি ওঠে না, তারা আমাদের বাড়ি থেকে পানি নেয়। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে এলাকাবাসীর পানি নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
নগরীর বাইতিপাড়া এলাকার বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ ও রিয়াজ শেখ বলেন, গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে এলাকার নলকূপে পানি উঠছে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, নগরী এবং সংলগ্ন এলাকাগুলোতে জলাশয় এবং বৃষ্টিপাতের সময়সীমা কমে গেছে। এছাড়া ভূ-গর্ভ থেকে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তার সমপরিমাণ পানি ভূ-গর্ভস্থ স্তরে জমা হচ্ছে না। এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে এবং প্রতি বছরই পানি সংকট বাড়ছে।
বেসরকারি সংস্থা অ্যাওসেড এর নির্বাহী পরিচালক শামীম আরফীন বলেন, নগরীতে উদ্বেগজনক হারে সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে ভূ-গর্ভের পানি তোলা হচ্ছে। আগে বছরে গড়ে ৯০ থেকে ১০৫ দিন বৃষ্টি হতো, এখন হয় ৪৫ থেকে ৬০ দিন। এছাড়া জলাশয়গুলো ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে যে পরিমাণ পানি তোলা হচ্ছে সেই পরিমাণ পানি ভূ-গর্ভে রিজার্ভ হচ্ছে না। যা ভবিষ্যতে পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ বলেন, ভূ-গর্ভস্থ ১ হাজার লিটার পানি তুলে সরবরাহ করতে তাদের ব্যয় হয় ১০ টাকা। আর মধুমতী নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহে ব্যয় হয় ১৭ টাকা। ব্যয় কমাতে ভূ-গর্ভের পানি তোলা বন্ধ করেনি তারা। তারা গ্রাহকের কাছ থেকে ১ হাজার লিটার পানির মূল্য নেন ৮ টাকা ৯৮ পয়সা।
তিনি বলেন, যদি মধুমতী নদীর আরও বেশি পরিমাণ পানি তারা পরিশোধন করেন তাহলে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। তখন তাদের ভর্তুকিও বেশি দিতে হবে। তাছাড়া এই মুহূর্তে তারা গ্রাহকের ওপর বাড়তি বিলের বোঝা চাপাতে চাইছেন না। সে কারণে ভূ-গর্ভ থেকে পানি তোলা বন্ধ করা হয়নি।
এতো বেশি ব্যক্তিগত নলকূপ ও সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। কিন্তু এখনও প্রায় ২০ শতাংশ পরিবার ওয়াসার পানির সংযোগ গ্রহণ করেনি। তারা নলকূপ ও পাম্প দিয়ে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করে।