স্টাফ রিপোর্টার।।
বিভিন্ন ব্যক্তিকে নানা প্রলোভন দিয়ে টাকা নেওয়া, টাকা হাতিয়ে নিয়ে জাল নথি দেওয়া ও সেই টাকা ফেরত চাইলে গ্রেফতার করে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হুমকী। এটাই ছিল পুলিশের সহকারি উপ পরিদর্শক (এএসআই) মো. মিরান শেখের প্রধান কাজ। এর পাশাপাশি তরুনীদের ব্লাক মেইল করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য কারানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এক থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় নানা অভিযোগে তিনি বদলি হন অন্য থানায়, সেখানে গিয়েও নতুন করে শুরু করেন বিতর্কিত কর্মকান্ড। পুলিশের দপ্তরে তথ্য প্রমানসহ এমন ২৬ টি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে জমা দিয়েছেন ভুক্তভূগীরা। এর মধ্যে একটি অভিযোগের তদন্ত শেষে তাকে চাকুরী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
মো. মিরান শেখের বাড়ী খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার ভান্ডারকোট গ্রামে। তিনি পুলিশে কনেস্টবল পদে দীর্ঘদিন চাকুরী করার পরে এএসআই পদে পদোন্নতি পান। আর পদোন্নতি পাওয়ার পরেই শুরু হয় তার অপকর্ম। কনেস্টবল পদে তিনি খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন থানায় চাকরী করেছেন। এছাড়া পদোন্নতির পর তিনি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সোনাডাঙ্গা, সদর ও খালিশপুর থানায় চাকুরী করেছেন। সর্বশেষ তিনি চাকুরী করেছেন মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী থানা।
মৌলভিবাজার জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, গত ১৩ মার্চ তাকে জুড়ী থানা থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। মৌলভিবাজার জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে মৌলভীবাজার পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।’ পুলিশ সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা জেলা থেকে মো. কামরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে পুলিশ দপ্তরে অভিযোগ করেছিলেন।
সেই অভিযোগ মতে, প্রায় ১৫ বছর আগে মো. মিরান শেখ সাতক্ষীরা জেলার সদর থানায় কেনস্টবল পদে কর্মরত ছিলেন। তখন সেখানের মো. কামরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির সাথে তার পরিচয় হয়। ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর পুলিশের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে মো. কামরুজ্জামানের বড় ছেলে মো. মেহেদী হাসানকে পুলিশের বাবুর্চি পদে চাকুরীর দেওয়া কথা বলে চুক্তিবদ্ধ মিরান। এর জন্য তিনি ওই বছরের ২৩ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সাতক্ষীরা শাখার মাধ্যমের একই ব্যাংকের বাগেরহাট জেলার গৌরম্বা বাজার শাখায় মো. মিরান শেখের অ্যাকাউন্টে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ১১৫ টাকা পাঠান। পরবর্তীতে চাকুরী হয়ে গেছে এমন সংবাদ পেয়ে ডাচ বাংলা ব্যাংকের সাতক্ষীরা শাখা থেকে মিরানের অ্যাকাউন্টে আরও ২ লাখ টাকা পাঠান। এরপর ২০২১ সালের ২৮ মার্চ ডাকের মাধ্যমে মো. মেহেদী হাসানের নামে একটি জাল নিয়োগ পত্র পাঠান মিরান। পরে তাদের বাসায় গিয়ে আরও ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আসেন। তবে মো. মেহেদী হাসান চাকুরীতে যোগ করতে গেলে জানতে পারেন তাকে পাঠানো নিয়োগপত্রটি জাল।
এই অভিযোগটির পরিপ্রেক্ষিতে সাতক্ষীরা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) অনুসন্ধান করে প্রমাণ পান। এরপর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স চলতি বছরের ৪ মার্চ তদন্তের মূল প্রতিবেদন মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পাঠায়।
এএসআই মো. মিরান শেখের এই প্রতারণা সূত্র খুঁজতে গিয়ে আরও কিছু তথ্য প্রমান হাতে এসেছে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ২৬ টি অভিযোগ মো. মিরান শেখের বিরুদ্ধে জমা রয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে আলোচিত অভিযোগ রয়েছে, পিবিআই পরিদর্শক মঞ্জুরুল হাসান মাসুদকে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসানো।
খুলনা সদর থানা সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ১৫ মে এক কিশোরীর বাবা পিবিআই পরিদর্শক মঞ্জুরুল হাসান মাসুদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। তবে মামলাটির তদন্তের বেরিয়ে এসেছে যে কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল, তিনি খুলনার খালিশপুরের একটি বাসায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দীর্ঘদিন এএসআই মিরানের সাথে বসবাস করেছেন। আর এএসআই মিরান পরিদর্শক মঞ্জুরুল হাসান মাসুদের কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেই টাকা পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল মাসুদ। তাই টাকা পরিশোধ না করে মাসুদকে হয়রানি করতে ওই কিশোরীকে দিয়ে তিনি মিথ্যা মামলা দায়ের করিয়েছিলন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি তদন্ত করেন খুলনা সদর থানার এসআই লতিফা রহমান পপি ও এসআই নান্নু মণ্ডল। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নান্নু মণ্ডল গত বছরের ১২ অক্টোবর মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। পরে ২৯ জানুয়ারি খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক আব্দুল সালাম মাসুদকে বেকসুর খালাস দেন।
মাসুদের আইনজীবী নজরুল ইসলাম জানান, ‘মাসুদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মামলা করা হয়েছিল। সেটা আদালতে প্রমানিত হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে এসআই মিরান জড়িত থাকায় তদন্ত কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। পরবর্তীতে পরিদর্শক মঞ্জুরুল হাসান মাসুদ বাদি হয়ে এএসআই মিরানসহ ওই কিশোরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।’
এছাড়া ২০২২ সালের শুরুতে নড়াইলের বাসিন্দা প্রতাপ চন্দ্র রায়কে সরকারি চাকরী দেওয়া বিষয়ে আশ্বস্ত করেন এএসআই মিরান। তখন তাদের দুইজনের মধ্যে ৩০০ টাকা স্ট্যাম্পে ১৭ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তিনি ওই বছরের ১৭ জানুয়রি খুলনার ডাচ বাংলা ব্যাংক থেকে ৪ লাখ ও ২০ জানুয়ারি আরও ৪ লাখ টাকা মিরানকে প্রদান করেন।
প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, ‘মিরান আমাকে কথা দেন ৬ মাসের মধ্যে তিনি আমাকে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিবেন। আমি চাকুরী পাওয়ার পরে তাকে বাকি ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করবো। তবে ৬ মাস অতিবাহিত হলেও তিনি আমাকে চাকুরী দিতে পারেননি। তখন তাকে দেওয়া ৮ লাখ টাকা চাইতে গেলে আমাকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটানোর হুমকী দেন।’
এছাড়াও, খুলনা মহানগরীর মিঞাপাড়া একালার বসিন্দা আমিনুল ইসলাম খানের ছেলেকে খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার কথা বলে দেড় লাখ টাকা, বটিয়াঘাটার মো. মিরানকে ফায়ার সর্ভিসে চাকুরী দেওয়ার প্রলোভনে ৭ লাখ টাকা, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার গৌরম্বা বাজারের দেবাশীষ পোদ্দারের কাছে থেকে ৭ লাখ টাকার স্বর্ণ ক্রয় করে ডিসঅনার চেক প্রদান, খুলনার টুটপাড়া খালপাড় এলাকার সিদ্দিকুর রহমানের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা ধার, কেএমপির পুলিশ লাইনের পিছনের এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগমকে ব্যবসায়ী অংশদার করানোর জন্য চেকের মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
খুলনা সদর থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ‘দুর্নীতির মাধ্যমে নামে বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন মিরান শেখ। খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গা আবাসিক, ময়ূরী আবাসিক একালায় ও সাচিবুনিয়ায় তার একাধিক প্লট রয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘খুলনার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে নারীদের দেহ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন মিরান শেখ। অবৈধ কাজে জড়িত আবাসিক হোটেল থেকে তিনি নিয়মিত চাঁদা তুনতেন। এছাড়া প্রেমিকের সাথে কেউ আবাসিক হোটেলে গেলে, তাদের গোপন ভিডিও ধারণ করে, পরবর্তীতে সেই কিশোরীকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করতেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সোনাডাঙ্গা থানায় থাকা কালে নানা অভিযোগে জড়িয়ে পড়লে তাকে সদর থানায় বদলি করা হয়। সেখানে এসেও অপকর্ম শুরু করলে তাকে খালিশপুর থানায় বদলি করা হয়। তবুও তার অবৈধ কর্মকান্ড না থামায় পুলিশ হেডকোয়াটারের মাধ্যমে তাকে সিলেট রেঞ্জে বদলি করে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ।’
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনা জেলার সভাপতি মো. কুদরত বলেন, ‘পুলিশ হল আইনের রক্ষক, তারা জনগনকে নিরাপত্তা দিবে। সেখানে পুলিশের কর্মকর্তাই যদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে, তাহলে জনগন কোথায় যাবে। পুলিশের উর্ধ্বত্তন কর্মকর্তাদের উচিত, এই ধরনের বিতর্কিত কিছু পুলিশ সদস্যদের কঠোর শাস্তিত আওতায় আনা। না হলে মাত্র কয়েকজনের জন্য গোটা জনগনই পুলিশের উপর আস্থা হারাবে।’