অর্থকরী ফসল গোলগাছ: বহুমুখী ব্যবহার, বাড়ছে সুস্বাদু রস ও গুড়ের কদর

9

খুলনাঞ্চল রিপোর্ট
গোল গাছ। একটি অর্থকরী ফসল। পটুয়াখালীর উপকূলীয় সাগরপারের এ জনপদে গোল গাছ সকল শ্রেণির মানুষের কাছে পরিচিত। বহুমুখী ব্যবহারে এর বিকল্প নেই। এক সময়, (ষাটের দশকে) এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে গোল গাছ ছিল না। বিশেষ করে জোয়ারের পানি প্রবহমান এমন খালের পাড়ে কিংবা বিলে গোলগাছের বাগান ছিল। খাল-বিলের এই অঞ্চলে মাইলের পর মাইল গোল বাগানে পরিপূর্ণ ছিল। গোল গাছের কদর ছিল অনেক বেশি। বিশেষ করে গোলের গুড়ের রয়েছে আলাদা কদর। কৃষিকাজের পাশাপাশি গোলগাছের আবাদ করা যায়। আশির দশক পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ ঘরের চালের ছাউনি, বেড়া দিত গোলপাতা দিয়ে। আর গোলের পাতা কাটার পরে গোড়ার অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিছুই ফেলনা নয়। এখন গোল গাছ আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে।

’৬০ এর দশকে কৃষিজমি চাষাবাদের উপযোগী করতে লোনা পানির প্লাবন ঠেকাতে নদীর পাড় ঘিরে বেড়িবাঁধ করা শুরু হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এবং ধানসহ রবিশস্য ও সবজির আবাদ করতে এই বাঁধ দেয়া হয়। নির্মিত হয় বাঁধের ভেতরের খালের সঙ্গে পানি নিয়ন্ত্রণে স্লুইস গেট। লোনা পানিতে বেঁচে থাকার এই গাছ তখন থেকে কমতে থাকে। এখনো সব ক’টি ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের বাইরে গোল গাছ রয়েছে। বেড়িবাঁধের অভ্যন্তরে কিছু কিছু গোল গাছের বাগান দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গোল গাছ রয়েছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নে। বিশেষ করে নবীপুর এবং সোনাতলা গ্রামের চাষিরা এখনো গোল গাছের বাগান সংরক্ষণ করে আসছেন।
সুস্বাদু হওয়ায় গোলের গুড় সংগ্রহ করছেন, বিক্রি করছেন। বাণিজ্যিকভাবে নতুন নতুন বাগানও করছেন কেউ। লাভের মুখ দেখছেন প্রায় একশ’ কৃষক পরিবার। এখন গোলের গুড়ের চাহিদা এই অঞ্চল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা তাদের প্রিয়জনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। গোল গাছ ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উপকূলীয় এবং মোহনা এলাকার এক প্রকার পাম জাতীয় উদ্ভিদ। যা নিপা পাম নামে পরিচিত। এটি পামের একমাত্র প্রজাতি, যা ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটা মূল গণনিপা হতে উদ্ভূত একমাত্র প্রজাতি যার উপপ্রজাতি নিপোডিয়া। এই অঞ্চল ছাড়াও বাগেরহাটের মোংলার মিঠাখালীতে খোনকার বেড় গ্রামে এক কৃষকের প্রায় দুই বিঘা জমিতে গোল গাছের বাগান রয়েছে। যেখানে কৃষি অফিস পরামর্শ দিয়ে ২০১০ সালের দিকে রস থেকে গুড় তৈরিতে সহায়তা করছিল। মোংলা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান পরিবেশ সংগঠক মো. নুর এ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে বর্তমানে সেখানকার গোলের গুড় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে গোল গাছ রয়েছে। তবে নীলগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে গুড় সংগ্রহের জন্য কয়েকটি গোল গাছের বাগান রয়েছে। বিশেষ করে নবীপুরের চাষিরা গোলবাগানের বিশেষ পরিচর্যা করেন।

গোল গাছ দেখতে গোল নয়। এর পাতা নারিকেল গাছের মতো লম্বা হয়। ১০ ফুট থেকে কোনো কোনো উর্বর জায়গায় ১৫-১৬ ফুট দীর্ঘ গোলগাছ দেখা যায়। বিশেষ করে শীত মৌসুমের আগেই গোল গাছে ফল ধরে। একটি কান্ডে ফল ধরে। যাকে স্থানীয় ভাষায় গাবনা বলা হয়। তাল গাছের ডগার মতো গোলের কান্ডে এই গাবনা বা ফল ধরে। এমন ফলওয়ালা কান্ড কেটে রস সংগ্রহ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় ছড়াসহ গাবনাটি কোনো এক পূর্ণিমায় পায়ের লাথিতে কান্ডসহ নিচের দিকে বাঁকা করা হয়। কেউ কেউ কাদা মেখে রাখেন। গোল চাষিদের ধারণা বা বিশ্বাস নির্দিষ্ট গোনে গাবনাসহ কান্ডটি নিচের দিকে বাঁকা করলে বেশি রস পাওয়া যায়। এরপরে ফলটি থোকাসহ এক কোপে কেটে কান্ডটি তালের রস সংগ্রহের মতো অল্প অল্প কেটে গোলের রস সংগ্রহ করতে থাকে। গুণগত কারণে গোলের এবং খেজুরের গুড় সহজভাবে আলাদা করা যায়। এরপরে খেজুর গুড়ের মতো আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। কিছুটা নোন্তা-মিঠার মিশ্রণ এই গুড়। ডায়াবেটিসের রোগীরা খেতে পারে বলে গুড় সংগ্রহকারীদের মতামত। আবার খেজুরের রসের মতো এই রস খেতেও সুস্বাদু। স্বাদের পাশাপাশি গোলের গুড়ের ঔষধি গুণ রয়েছে। কথিত রয়েছে, গোলের গুড় কিংবা রস খেলে পেটের কৃমি বিনাশ হয়। আবার বাসি রস খেলে তাড়ির মতো নেশা হয়। কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. চিন্ময় হাওলাদার জানান, এই গুড়ের এক ধরনের ভিন্নতর স্বাদ রয়েছে। আর যেহেতু এই গুড়ে খনিজ লবণ রয়েছে। যেটি মানুষের জন্য অনেক ক্ষেত্রে উপকারী।
নবীপুর গ্রমের উত্তম কুমার সরকার জানান, এখন বাড়িতে বসেই তিনি গুড় বিক্রির অর্ডার পেয়ে আসছেন। চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। তার তথ্যমতে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে ২২জন, নেয়ামতপুর গ্রামে আট জন, গুটটাবাছা গ্রামে এক জন, চাঁদপাড়া গ্রামে ৭/৮ জন, তাহেরপুর গ্রামে ৫/৬ জন, দৌলতপুর গ্রামে তিন জন, নাওভাঙ্গায় চার জন, ইসলামপুর গ্রামে চার জন। এছাড়া মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের চরপাড়া- তেগাছিয়ায় তিন/চারজন। চাকামইয়া ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া ও নেওয়াপাড়া গ্রামে ৬/৭ পরিবার গোলের গুড় তৈরি করেন। করেন গোল গাছের আবাদ। এ চাষির হিসেবে প্রায় ৮০ জন চাষি বাণিজ্যিকভাবে গোলের চাষাবাদ করেন। গুড় বিক্রি করেন। এসব চাষির দেয়া তথ্যানুসারে একেকটি পরিবার ফি মৌসুমে ৩০-৫০ হাজার টাকা লাভ করেন গোলের গুড় বিক্রি করে। মঙ্গলবার কলাপাড়ার সাপ্তাহিক হাঁটের দিনে ৩০-৪০ মণ গোলের গুড় বিক্রি হয়। এসব চাষিদের তথ্যে ফি বছর অন্তত ৪৫-৫০ লাখ টাকার গোলের গুড় কলাপাড়ায় উৎপাদন হয়। বর্তমানে গোল গাছ অর্থকরি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কৃষকের কাছে।