খুলনাঞ্চল রিপোর্ট।।
ঝিনাইদহের সদর উপজেলার শ্যামনগর গ্রামে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটা নষ্ট করছে ৩০ বিঘা কৃষিজমি। বছর পাঁচেক আগে এ সব জমিতে তিন আবাদী ফসল হলেও এখন জমিগুলো ভরে গিয়েছে ইট-টুকরোর স্তূপে। ২০১৭ সালে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাটি চলছে গায়ের জোরে। জেলা প্রশাসনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না ইটভাটার বিরুদ্ধে।
ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে জমি ফেরত চেয়েও পাচ্ছেন না শ্যামনগর ও বড়বাড়ী গ্রামের স্থানীয় কৃষকরা। এমন অবস্থায় নিজেদের কৃষি জমি উদ্ধারের পাশাপাশি অবৈধ এই ইটভাটা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, ঝিনাইদহের শ্যামনগর গ্রামে অন্তত ৩০ বিঘা কৃষিজমির ওপর অনুমোদনহীন ইটভাটাটি গড়ে ওঠেছে। ওই ইটভাটায় অন্তত ১৫ কৃষকের জমি রয়েছে। এই জমিগুলো একসময় তিন আবাদি ফসলি জমি ছিল।
ইটভাটার উদ্যোক্তা সাজেদুর রহমান শিপার অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে সহজ-সরল কৃষকদের কাছ থেকে জমি বর্গা নেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও কৃষকদের মুনাফা বাড়েনি। এমন অবস্থায় চাষাবাদের জন্য কৃষকরা জমি ফেরত চাইলে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বছর সাজেদুর রহমান শিপারের পাশাপাশি ইটভাটাটি অংশীদারভিত্তিতে লিজ নিয়েছেন নওদাপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেন। এই আলতাফ হোসেন এখন পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন, দেখাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভয়ও।
ভুক্তভোগী কৃষকরা জানান, বাসনা ইটভাটার কারণে ভাটার আশেপাশের কৃষিজমিতেও ফলন কম হচ্ছে। ধোঁয়া উড়ছে, ধুলো উড়ছে। আশেপাশের বাড়িঘরের আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। ভাটার কারণে আশেপাশের সবজিক্ষেত, ধান ও ভুট্টার ক্ষেত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই ইটভাটায় জমিদাতার মধ্যে রয়েছেন শ্যামনগর গ্রামের জামতলাপাড়ার আইয়ুব মিয়া। তিনি দিয়েছেন ১১ বিঘা জমি। জমি দিয়েছেন বড়বাড়ী গ্রামের কলিমুল্লাহ, তার ছেলে মফিজুর, শ্যামনগর গ্রামের ছমির উদ্দীন, কাশেম, নুজদার। তারা এখন জমি ফেরত চাইছেন।
কৃষক আইয়ুব মিয়া বলেন, ‘আমি ইটভাটায় জমি দিয়েছিলাম। এখন সেই জমি ফেরত চাইছি। কিন্তু জমি দেওয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে খুব বিপদে আছি। আমাদের হামলা-মামলার ভয় দেখানো হচ্ছে।’
কৃষক মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের জমিতে এখন চাষাবাদ করব। জমি চাইছি। কিন্তু ইটভাটার মালিক ও তার লোকজন ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।’
কৃষক মো. কাশেম বলেন, ‘আমিও জমি ফেরত চেয়েছি। আজ দেবে, কাল দেবে করে সময় নষ্ট করছে। কবে ফেরত দেবে তা বলছে না।’
শ্যামনগর গ্রামের কৃষক নুজদারের ছেলে মো. জাহিদ বলেন, ‘ইটভাটার কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ধুলোবালিতে ঘরবাড়ি নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। আমরা জমি ফেরত চাইছি। কিন্তু কবে জমি ফেরত পাবো জানি না।’
তিনি বলেন, ‘ইটভাটায় আমার ৩০ শতক জমি আছে। জমি ফেরত পেলে চাষাবাদ শুরু করব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাসনা ইটভাটাটির কার্যক্রম চলছে অবৈধভাবে। এই ইটভাটার অনুমোদন নেই। নেওয়া হয়নি পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও। ইটভাটার নিকটে মধুহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধুহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে কোনোভাবেই ইটভাটা স্থাপন না করার বিধান থাকলেও বাসনা ইটভাটা সেই নিয়ম মানেনি।’
স্থানীয় কৃষকদের ভাষ্য— ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা ইটভাটা সমিতির সভাপতি সাইদুল করিম মিন্টু এতে ইন্ধন দিচ্ছেন। তিনিই সামলে নিচ্ছেন প্রশাসনিক ঝক্কি-ঝামেলা।
ইটভাটার পার্টনার আলতাফ বলেন, ‘আমাদের অনুমোদন আছে। অনুমতি ছাড়া আমরা ব্যবসা করছি নাকি? আপনি যা পারেন তাই করেন।’
ইটভাটার কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে ভাটার আরেক মালিক সাজেদুর রহমান শিপারকে কল করা তিনি কল ধরেননি।
মধুহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলতাফ হোসেন বলেন, ‘শ্যামনগর গ্রামের ওই ইটভাটার অনুমোদন নেই। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও কোনো ধরনের সম্মতিপত্র দেওয়া হয়নি।’
ইটভাটাটি কৃষিজমি নষ্ট করছে— এমন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘কৃষকরা আমার কাছে অভিযোগ দেয়নি। লিখিত অভিযোগ দিলে আমি দুইপক্ষের কথা শুনতে চাইব। প্রয়োজনে জেলা প্রশাসনকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে অবহিত করা হবে।’
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, ‘যে সব ইটভাটা ২০-২৫ বছর ধরে ব্যবসা চালাচ্ছে তাদের অবৈধ বলা যাবে না। কিন্তু যারা কৃষিজমি নষ্ট করছে, গাছের খড়ি পোড়াচ্ছে তারা অবৈধ। এরকম ইটভাটা বন্ধ হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘এ সব ইটভাটা বন্ধ হলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ইটভাটা না থাকলে সস্তায় ইট পাওয়া যাবে না, তখন ইটের দাম বাড়বে। এই বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে।’