খাসজমিতে সমান অধিকার দাবি উপকূলের জেলেদের

3
Spread the love

স্টাফ রিপোর্টার।।
দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে অনন্য ভূমিকা পালন করছেন সমুদ্রগামী জেলেরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর সমুদ্রে গিয়ে এসব জেলে রাজস্ব জোগান দিচ্ছেন বিনা আপত্তিতে। আগে যেখানে জোগান দিতেন ২০০ টাকা, এখন দিচ্ছেন ৪০০ টাকা। কিন্তু সরকারি খাসজমিতে অধিকার নেই এসব জেলের।

দেশের খাসজমিতে কৃষকের অধিকার আছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লাখ জেলে পরিবার অসহায় জীবন যাপন করছেন। কিন্তু সমুদ্রগামী এসব জেলের কোনও অধিকার নেই খাসজমিতে। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাচ্ছেন না তারা। তাই সমুদ্রগামী জেলে ও উপকূলীয় নাগরিকরা সুনীল অর্থনীতি বিবেচনা করে ‘সমুদ্রগামী জেলেদে’র জন্য খাসজমি বরাদ্দ নীতিমালা পরিবর্তন চান।

মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লাখ জেলে কাজ করছেন। এর মাধ্যমেই তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। খুলনায় জেলের সংখ্যা ৪৩ হাজার ২১৯ জন। এর মধ্যে উপকূলীয় এলাকার সমুদ্রগামী জেলের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩১ হাজার। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সমান অধিকার থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত।

জেলেরা নদীতীরবর্তী এলাকায় বসবাসের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ভাঙনে গৃহহীন ও ভূমিহীন হয়ে পড়েন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ধাক্কাটা আগেই বুকে আগলে নেন জেলেরা। কিন্তু কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা-১৯৯৭ ও অকৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা-১৯৯৫ অনুযায়ী জেলের খাসজমি প্রদান বিষয়টি যুক্ত হয়নি। তাই জেলেরা খাসজমি বরাদ্দ পাচ্ছেন না।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হেতামপুরের বাসিন্দা রাম বিশ্বাস (৪৫) বলেন, ‘অনেক জেলের জমিজমা কিছু নেই। কপোতাক্ষে সব গেছে। তারা এখন সাগরে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন। কৃষকরা খাসজমি, ঘর পান। কিন্তু ভূমিহীন জেলেরা খাসজমি বরাদ্দ পান না।’

পাইকগাছার বোয়ালিয়া গ্রামের রুহিদাস বিশ্বাস বলেন, ‘বাড়িতে বউ, ছেলে-মেয়ে রেখে জেলেরা সমুদ্র পাড়ি দেন। কিন্তু সরকারি খাসজমি বরাদ্দ না পান না। আর নদীর পাড়ে পরিত্যক্ত জমিতে কোনও রকমে বাস করার পরও জেলেরা উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকেন।’

রামনাথপুরের গৃহবধূ শেফালী বিশ্বাস বলেন, ‘বাড়ির দুই পাশে ইটভাটা। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। ইটের সঙ্গে আমরাও পুড়ি। কিছু বললেই বিপদ। নদীর চরে বাস। ভূমিহীনরা খাসজমি পায়। কিন্তু জেলেদের নাকি সে অধিকারই নেই।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রূপান্তরের নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়ন করতে হলে সমুদ্রগামী জেলেদের প্রধান্য ও অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ, তারাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্লু ইকোনমি চাঙা রেখেছেন। তাই এসব জেলে জমি পেলে স্বাচ্ছন্দ্যে সমুদ্রে চিন্তা ও চাপমুক্ত থেকে কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন।’

সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বিদ্যমান আইনে কয়কটি শব্দ সংস্থাপন করলেই সমুদ্রগামী জেলেদের খাসজমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হবে। সরকারের স্বার্থেই খাসজমিতে জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ কাজটুকু করা প্রয়োজন।’
দুবলার চর ফিশারম্যান গ্রুপের প্রধান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জেলেদের দুর্ভোগ ভাষায় প্রকাশ করে সাধারণ মানুষকে বোঝানো কঠিন। জেলেরা অবর্ণনীয় কষ্ট ও ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে যান। অনেকে মারাও যান। অসুস্থ হলে সাগরের মাঝে কোনও চিকিৎসা নেই। অনেক সময় সাগরে হারিয়ে যান। কিন্তু এসব জেনেও জেলেরা সমুদ্রে যান। তারা পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নেন বটে। মূলত তারা সরকারের সুনীল অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করছেন। সেই জেলেরা খাসজমিতে অধিকার পান না। এটা সরকারের বোঝা উচিত। কারণ, ব্লু ইকোনমির প্রধান দায়িত্বেই এই সমুদ্রগামী জেলেরা।’

উপকূলীয় পানি সম্মেলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামীম আরফীন বলেন, ‘সমুদ্রগামী জেলেরা এ দেশের সম্পদ। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তাদের সহায়তা কম। তাদের খাসজমিতে অধিকার নেই। খাসজমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় জেলেরাই এখন সরব হচ্ছেন।’

খুলনা ৬ আসনের সংসদ মো. আখতারুজ্জামান বাবু বলেন, ‘সমুদ্রগামী জেলেরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। খাসজমিতে অধিকার পাওয়ার তাদের দাবি যৌক্তিক। বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’