মৃতের ফোন থেকে মেসেজ, সেই মুর্শিদার মৃতু্্য নিয়ে তোলপাড়

1

 

খুলনাঞ্চল রিপোর্ট।।

রাজশাহী মহানগরীর ভদ্রা জামালপুর মহল্লার মাজদার হোসেনের মেয়ে ২৬ বছরের মুর্শিদা খাতুন গত ৮ নভেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মুর্শিদার হাতে লেখা একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে।

 

তদন্তের প্রয়োজনে মুর্শিদার স্মার্টফোনটিও জমা নেন তদন্ত কর্মকর্তা। ওই দিনই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক বিভাগে ময়নাতদন্ত শেষে আরএমপির চন্দ্রিমা থানা পুলিশ মুর্শিদার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। রাতেই মুর্শিদার দাফন সম্পন্ন হয়।

 

চন্দ্রিমা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) প্লাবন কুমার বাদী হয়ে থানায় ইউডি মামলা দায়ের করেন। এসআই প্লাবন মামলাটির তদন্তভারও পান।

 

এখনো পর্যন্ত মুর্শিদা আত্মহত্যা ঘটনাটির আইনি প্রক্রিয়া ঠিকঠাকই ছিল; কিন্তু মৃত মুর্শিদা খাতুনের স্মার্টফোনটি নিয়ে সম্প্রতি রাজশাহী মহানগর পুলিশে তোলপাড় ও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

 

জানা গেছে, ঘটনার দিন মুর্শিদার বাবার হাত থেকে মোবাইল ফোনটি নেন চন্দ্রিমা থানার ওসি এমরান হোসেন। ওসি মুর্শিদার বাবাকে বলেছিলেন তদন্তের সময় আলামত হিসেবে মোবাইল ফোনটি কাজে লাগবে। এই মোবাইল ফোনটি মিসিং হওয়া নিয়েই আরএমপিতে তোলপাড় চলছে।

 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার কয়েক দিন পর মুর্শিদার বাবা মাজদার হোসেন তার মেয়ের ফোনটি ফেরত চেয়ে চন্দ্রিমার ওসি, তালাইমারী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আশিকুর রহমান ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই প্লাবন কুমারকে ফোন দেন; কিন্তু এই তিন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে জানিয়ে দেন তাদের কাছে মুর্শিদার ফোন নেই। ফোনটি তারা খুঁজে দেখবেন। পেলে ফেরত দেওয়া হবে। মুর্শিদার বাবা তার মেয়ের ফোনটি ফেরত পেতে কয়েকবার চন্দ্রিমা থানাতেও যান। প্রতিবারই থানা থেকে বলা হয়েছে- খুঁজে পেলে ডেকে নিয়ে ফেরত দেবেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিন আগে মুর্শিদা খাতুনের হারানো মোবাইল ফোন থেকে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ আরএমপির বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে কয়েকটি রহস্যময় এসএমএস যায়।

 

সেই খুদেবার্তাগুলোতে বলা হয়, মুর্শিদা খাতুনকে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছিল। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এজন্য দায়ী। এ ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ৩২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে ওসির সঙ্গে। খুদেবার্তাগুলোতে ওসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগও করা হয়।

 

আরও জানা যায়, এই খুদেবার্তাগুলো খোদ ওসির সরকারি মোবাইল ফোনেও যায়।

 

এদিকে খুদেবার্তায় নিজের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিষয়ে জানতে পেরে চন্দ্রিমার ওসি এমরান হোসেন কয়েকবারই মুর্শিদার বাবার বাড়িতে যান। মুর্শিদার মোবাইল ফোন থেকে কারা এসব বার্তা পাঠাচ্ছে- বিষয়টি তিনি জানতে চান।

 

কিন্তু মুর্শিদার বাবা ওসিকে জানিয়ে দেন, ঘটনার দিন মোবাইল ফোন তো আপনিই নিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। মুর্শিদার ফোনও তো আমরা ফেরত পাইনি।

 

মুর্শিদার বাবার সঙ্গে কথা শেষে ওসি নিশ্চিত হন, মুর্শিদার মোবাইল ফোনটি থানায় দায়িত্বরত কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছেই ছিল অথবা আছে। সেই অজ্ঞাত পুলিশ কর্মকর্তাকে শনাক্তে ওসি নানা উপায়ে চেষ্টা করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি।

 

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, শেষপর্যন্ত চাঞ্চল্যকর মুর্শিদার মোবাইল ফোন মিসিং ঘটনাটি তদন্তের জন্য আরএমপির সাইবার সেলে পাঠিয়েছেন আরএমপি কমিশনার। মুর্শিদার মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীকে শনাক্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 

বর্তমানে আরএমপির সাইবার সেলের ইনচার্জ সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার উৎপল চৌধুরী এ বিষয়ে কাজ করছেন। তবে উৎপল চৌধুরীর সঙ্গে মঙ্গলবার দুপুরে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেন।

 

ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুর্শিদার বাবা মাজদার হোসেন একজন গরিব চা বিক্রেতা। নগরীর ভদ্রা জামালপুর মহল্লায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আট বছর আগে মেয়ে মুর্শিদার বিয়ে হয়েছিল একজন প্রতিবন্ধী যুবকের সঙ্গে। মুর্শিদার সাত বছরের একটি সন্তান আছে।

 

ঘটনার তিন মাস আগে মুর্শিদা তালাক নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আসেন। মহল্লার আরেক মেয়ে রিতুর সঙ্গে প্রায়ই এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেন মুর্শিদা। নিয়মিত ফেসবুকে নিজের ছবি পোস্ট করতেন। একপর্যায়ে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। এ কারণে ঘুমের ওষুধ খেয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমাতেন। অপরিচিত ছেলেদের বাইকের পেছনে বসে তাকে ঘুরে বেড়াতেও দেখা যেত। এসব নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে মুর্শিদার ঝগড়া বিবাদ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিবেশীরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আত্মহত্যার আগের রাতে মুর্শিদা তার ফেসবুক আইডি নিষ্ক্রিয় করেন। আগের রাতে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন বান্ধবী রিতুর সঙ্গে। রিয়েলমি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনটিতে মুর্শিদা কাউকে হাতে দিতে দিতেন না। আত্মহত্যার আগেও মোবাইল ফোনটি তার পায়ের নিচেই পড়ে ছিল।

 

পুলিশ মুর্শিদার ঘরের দরজা ভাঙ্গার সময় তার বাবা ফোনটি হাতে নেন। কিছুক্ষণ পর তদন্তের প্রয়োজনের কথা বলে চন্দ্রিমা থানার ওসি ফোনটি মুর্শিদার বাবার হাত থেকে নেন। সেই ফোনটি আর ফেরত পাননি মুর্শিদার বাবা।

 

এদিকে মুর্শিদার মোবাইল ফোনটি ঘিরে রহস্য দানা বেঁধেছে। অনেকের প্রশ্ন- মুর্শিদার মোবাইল ফোনে কী এমন ছিল, যা তার আত্মহত্যার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। মোবাইল ফোনটি মিসিং হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে গভীর রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। শেষপর্যন্ত মোবাইল ফোনটি খুঁজে পেতে মরিয়া ও খুদেবার্তা প্রেরণকারীকে শনাক্তে প্রাণপণ চেষ্টা করছে সাইবার ইউনিট।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চন্দ্রিমা থানা থেকে সোমবার এয়ারপোর্ট থানায় বদলি হওয়া ওসি এমরান হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি।

 

বিষয়টি সম্পর্কে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, মুর্শিদার ফোন মিসিং ও সেই ফোন থেকে খুদেবার্তা পাঠানোর বিষয়টি আরএমপির সাইবার ইউনিট গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষ হলে ঘটনার বিষয়ে পুরোপুরি জানা যাবে। কে খুদেবার্তা পাঠিয়েছেন তাকেও শনাক্ত করা সম্ভব হবে।