বিশেষ প্রতিনিধি।।
বাংলাদেশের ৬৪ শতাংশ নারী অনলাইনে হয়রানি ও যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই এর প্রতিকারের জন্য পুলিশের কাছে যান না। যারা যান, তাদের অধিকাংশই কোনো প্রতিকার পান না। এ রকম সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। রোববার (২৭ নভেম্বর) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
‘পুরো পরিবার ৫ বছর বিভীষিকার মধ্যে ছিল’:
ঢাকায় বসবাসরত এক তরুণীর ২০১৫ সালে বিয়ে হয়। বিয়ের পর শুধু ওই তরুণী নয়, তার পুরো পরিবার অনলাইন, বিশেষ করে ফেসবুকে হয়রানির শিকার হন। তাতে ওই তরুণীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তার ভাই বলেন, ‘২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে এই হয়রানি অব্যাহত ছিল। পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পর ২০২১ সাল থেকে হয়রানি বন্ধ হয়। কিন্তু অপরাধীকে চিহ্নিত বা গ্রেপ্তার করা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমার বোনের বিয়ের পর একটার পর একটা ফেক ফেসবুক আইডি খুলে আমার বোন সম্পর্কে অশ্লীল কথা লিখে পোস্ট দেওয়া হতো। আর সেটা তার স্বামীর ইনবক্সেও পাঠানো হতো। এখানেই শেষ নয়, আমাদের পরিবারে সদস্যদের ইনবক্সেও পাঠানো হতো। বলা হতো তার কাছে অনেক ভিডিও এবং ছবি আছে, যা সে প্রকাশ করবে। হুমকি দিত। এক পর্যায়ে আমরা পুরো পরিবারই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার বোনকে তার স্বামীও ভুল বুঝতে শুরু করেন। দূরত্ব তৈরি হয়।’
তিনি বলেন, ‘কোনো উপায় না দেখে ২০২১ সালের প্রথম দিকে আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। এরপর থেকে ওই অজ্ঞাত ব্যক্তির তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তাকে গ্রেপ্তার বা চিহ্নিত করার কোনো খবর পুলিশ আমাদের দেয়নি।’
তার ভাষ্য, ‘পাঁচটি বছর আমার বোনসহ আমাদের পুরো পরিবারের সদস্যরা এক বিভীষিকার মধ্যে ছিলাম। আমরা আতঙ্কে থাকতাম, কখন অশ্লীল পোস্ট দেয়, মেসেজ পাঠায়। আমাদের পরিবারের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই কথা মনে পড়লে এখনো আমরা আঁতকে উঠি। আমার বোনটি এখন মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।’
আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন কেউ কেউ:
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী এখন মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। তিনি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা মাধ্যমে এখন হয়রানির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তার ফেসবুক থেকে ছবি নিয়ে সেটাই বিকৃত করে তার নামেই ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে হয়ররানি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘তারা আমার ছবি ও ভিডিও নিয়ে বিকৃত করে প্রচার করছে। প্রথম প্রথম এটা নিয়ে আমি খুব ডিপ্রেশনে থাকতাম। পরে মেনে নিয়েছি। আমার এখন ভাবনা, আমি যেহেতু মিডিয়ায় কাজ করি তাই আমাকে নিয়ে এ রকম হতেই পারে। আমি এখন আর পাত্তা দেই না।’
‘তবে ভয়াবহ ব্যাপার হলো হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে নানা অশ্লীল প্রস্তাব করা হয়, বাজে মন্তব্য করা হয়। এ নিয়ে আমি একবার পুলিশের শরণাপন্নও হই। কিন্তু প্রতিকার পাইনি। আরেকবার তারা আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সেখানে আমার ছবি বিকৃত করে নানা অশ্লীল ছবি দিয়েছে’, বলেন এই তরুণী।
তিনি বলেন, ‘আমি না হয় সামলে নিয়েছি। কিন্তু আমার পরিচিত অনেকেই পারছেন না। এ নিয়ে আমার পরিচিতদের মধ্যে সুইসাইডের মতো ঘটনাও ঘটাতে যাচ্ছিল। একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগডেতে নাচার ছবি ও ভিডিও নিয়ে অশ্লীল প্রচারও চলানো হয়।’
সংবাদমাধ্যমে এই রকম হয়রানির পর আত্মহত্যার খবর প্রায়ই দেখা যায়। গত ২২ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে এক কলেজছাত্রীর আপত্তিকর ভিডিও ফেসবুকে আপ করে দেওয়ার পর সেই তরুণী আত্মহত্যা করেন। গত ৭ জুলাই সাতক্ষীরায় একই ধরনের ঘটনায় এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
অ্যাকশনএইডের জরিপ:
অ্যাকশনএইডের ‘বাংলাদেশে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় যা ১৪ শতাংশ বেশি। এরমধ্যে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তারা। এই হার ৪৭ শতাংশ। মেসেঞ্জারে হারটি ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া ইনস্টাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবসহ অন্যান্য মাধ্যমেও সহিংসতার মুখে পড়েছেন নারীরা। গত ১১ থেকে ১৮ নভেম্বর ৫১৪ অনলাইন ব্যবহারকারী নারী তাদের এই গবেষণা জরিপে অংশ নেন।
গবেষণায় বলা হয়, অনলাইনে নারীরা ১২ ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি ৮০ শতাংশ নারী অশ্লীল, ক্ষতিকর, যৌনতামূলক ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য পেয়ে থাকেন। ৫৩ শতাংশ নারীকে ইনবক্সে অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে যৌন সম্পর্ক করার কথা বলে হয়রানি করা হয়। বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন ১৯ শতাংশ নারী। সামাজিক মাধ্যমে নারীদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া আইডি খোলার মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হয়েছেন প্রায় ১৮ শতাংশ নারী। ১৬ শতাংশ নারী বলেছেন, সাইবার জগতে তাদের কর্মকাণ্ড সব সময় অনুসরণ করা হচ্ছে।
২০২১ ও ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে অ্যাকশনএইড বলছে, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানোর হার খুবই কম, মাত্র ১৫ শতাংশ। যারা অভিযাগ করেছেন তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা প্রতিকার পাননি। আর যারা হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন তাদের মধ্যে কিশোরীও রয়েছেন।
‘সাহসী হতে হবে’:
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘আমরা তো সাইবার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারব না। তাই আমাদের অনলাইন লিটারেসি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের সতর্কতাগুলো বুঝতে হবে। আর এটার যে প্রতিকার পাওয়ার উপায় আছে, তা-ও সবাইকে জানাতে হবে। কোনো লজ্জার কারণে ভয়ে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকা নয়, সাহস নিয়ে অভিযোগ করতে হবে। আর সামাজে এই অপরাধ সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক ক্যাম্পেইন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং হয়রানি বাড়ছে। সরকার সাইবার ক্রাইম ইউনিট এবং অভিযোগের জন্য হটলাইন চালু করেছে। কিন্তু যারা এই অপরাধ নিয়ে কাজ করেন সেই পুলিশ সদস্যদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কারণ অধিকাংশ হয়রানি করা হয় ফেক আইডি থেকে। তাই অপরাধীকে চিহ্নিত করার জন্য দক্ষতা ও সাইবার জ্ঞান জরুরি।’
ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপপুলিশ কমিশনার হুমায়রা পারভীন বলেন, ‘অভিযোগ না করার অনেক সামাজিক কারণ থাকতে পারে। কেউ হয়তো লজ্জার ভয়ে অভিযোগ করেন না। কিন্তু সাইবার ক্রাইম ইউনিট এটা নিয়ে কাজ করছে, অভিযোগ নিচ্ছে। অভিযোগ করলে পুলিশ অবশ্যই প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। অভিযোগ করতে হবে।’