রওশন না কাদের: কে হবেন জাপার কাণ্ডারি?

27
Spread the love

ঢাকা অফিস।।

জাতীয় পার্টিতে কে হবেন কাণ্ডারি? এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ নাকি ছোট ভাই জি এম কাদের? এ নিয়ে দলটির তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতা-কর্মীদের মধ্যে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও একে অপরের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ জাপার কাকরাইল অফিসে বৈঠক করছেন। কেউ আবার বানানীতে চেয়ারম্যান কার্যালয়ে বসে পকেট বৈঠক করছেন।

ঢাকার আশেপাশের জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা অনেকেই দলটির বর্তমান পরিস্থিতি খুঁজতে ছুটে এসেছেন ঢাকায়। তারা বনানী কার্যালয়ে এবং কাকরাইল অফিসে গিয়ে নেতাদের কাছে জানতে চাইছেন কী হচ্ছে দলের মধ্যে?

তাদের প্রশ্ন আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময়ের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে পদ নিয়ে কাড়াকাড়ির ঘটনা জনগণের সামনে আসায় আমরাও প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। তবে কিছু চাটুকার নেতা-কর্মী সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় রয়েছে।

দলীয় অনেক এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যাংককে বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে ফোনে যোগযোগ রক্ষা করে চলছে। তবে সবাই ২৬ নভেম্বরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওই দিন চূড়ান্ত হবে কে হবেন জাপার কাণ্ডারি? দলের মধ্যে একাধিক নেতা সঙ্গে আলোচনা করে এ সব তথ্য জানা গেছে।

এ সব বিষয় নিয়ে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ফোন করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে প্রশ্ন করা হয়, জাপার পরিস্থিতি কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘সমস্যা কোথায়। সব ঠিক আছে। রাজনীতিতে এসব থাকবে।’

দলের কাণ্ডারি কে হবেন? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কাণ্ডারি তো আছেই।’

২৬ নভেম্বর কাউন্সিল সর্ম্পকে বলেন, ‘ওই কাউন্সিল আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোর কেউ ডাকেনি। ওটি আমাদের হেডেক না। বেগম রওশন এরশাদ দলের কিছু না। সদস্য মাত্র। একজন এমপি মাত্র। ওনার সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই। জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এটি অলংকারিক পদ।’

সংশ্লিষ্টদের অভিমত আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাকর্মী এবং এমপিরা পদক্ষেপ নেবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জি এম কাদেরর দিকে থাকবে দলটির একটি অংশ। আর বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দলের সব সংসদ সদস্যসহ নেতাকর্মীদের বিরাট অংশ রওশন এরশাদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে।
বিজ্ঞাপন

তাদের অভিমত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্টে বিশ্বাসী নয় জাতীয় পার্টি। কারণ ৯০ সালের পর ৯১ নির্বাচনে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় পার্টির সঙ্গে ভালো আচরণ করেনি।

ওই সময় জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রায়ত মিজান চৌধুরী জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। সেই দুর্দিনে জাতীয় পার্টির দলীয় প্যাডও ছিল না। ওই সময় কিছু ত্যাগী নেতা মিজান চৌধুরীর বাসায় সার্বক্ষণিক থেকে পাহারা দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে জাতীয় পার্টির তৎকালীন কর্মী মিলু চৌধুরী, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, জহিরুল হক রুবেল, জহিরুল ইসলাম জহির, ইকবাল হোসেন রাজু, গোলাম মোহাম্মদ রাজু আরিফ খাঁন অন্যতম। এ সব ত্যাগী কর্মীরা এখন দলটির বিভিন্ন পদে রয়েছেন। দলটির বর্তমান পরিস্থিতি হতাশাজনক। আর এই হতাশার ঢেউ কেন্দ্র থেকে জেলা ঘুরে উপজেলায় গিয়ে আছড়ে পড়ছে বলে জানায় নেতা-কর্মীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, ওইসময় জি এম কাদের মুক্ত থাকলেও তিনি কখনও দলের জন্য এবং তার ভাই সাবেক রাষ্ট্রপতির মুক্তির জন্য প্রকাশ্যে আসেনি। তৎকালীন সময় প্রবল উজানেও ৩৫টি আসনে জয়লাভ করেছিল জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এরশাদ একাই ৫টি আসনে জয়লাভ করে দেশে বিদেশে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন।

এরপর দলটি উজানে বৈঠা বেয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। এরশাদের মৃত্যুর পর শুরু হয় দেবর-ভাবির পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন প্রশ্নে দেবর জি এম কাদেরের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয় রওশন এরশাদের।

পাল্টাপাল্টি চিঠি দিয়ে হাস্যরসের জন্ম দেন। শেষ পর্যন্ত রওশনই বিরোধীদল নেতা হন। এরপরও নানা রকম টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যায় জাতীয় পার্টি। ভাঙতে গিয়ে খাদের কিনার থেকে উঠে দাঁড়ায়। শেষ মুহূর্তে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গারঁ মধ্যস্থতায় টিকে যায় জাপা।

এরপর অনেক ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে জাতীয় পার্টির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। রওশনপন্থী অনেক নেতার জন্য পদসৃজন করা হয় পার্টিতে। সৃজিত এ সব পদ পেয়ে জিএম কাদেরের দলে যোগদেন অনেক রওশনপন্থী নেতা। আর রওশনের জন্য প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদ সৃজন করা হয়। অনারারি এই পদের বিষয়ে রওশন এরশাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। প্রকাশ্য কোনো মন্তব্যও করেননি কখনো, চিঠিপত্রেও কখনো এই পদবি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

এই কাউন্সিলে রওশন এরশাদ হাজির ছিলেন না। কাউন্সিলের পর এক চিঠি দিয়ে ছেলে সাদ এরশাদকে কো-চেয়ারম্যান এবং কয়েকজন নেতাকে পদায়ন করতে চিরকুট দিয়েছিলেন। সেই চিরকুটও সামান্যই বাস্তবায়ন হয়েছে।

রওশন এরশাদ প্রকাশ্য কিছু না বললেও তিনি যে ক্ষুব্ধ এটি নেতাকর্মীদের মধ্যে কানাঘুষা রয়েছে।

দলীয় নেতা-কর্মীরাদের অভিমত তারা আশা করেছিল দলটি চাটুকার মুক্ত হবে। তা হয়নি। জি এম কাদের দলটির দায়িত্ব নেওয়ার পর চটুকারদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে।

অল্প কয়েকজন লোক এমনভাবে মহীরূহ হয়ে উঠেছেন, তারাই এখন দুইমুখের কর্তায় পরিণত হয়েছেন। তাদের আজ্ঞাবহদের এখন সর্বত্র জয়জয়কার। যারা কর্মী ছিলেন, তাদের নিয়ে বসানো হয়েছে নেতাদের ওপরে। কর্মী থেকে হঠাৎ করে নেতা বনে যাওয়া এসব নেতাদের পেছনে কাজ করতে বিব্রত বোধ করছেন পুরনো নেতারা। এলাকায় কোন অবস্থান নেই, সংগঠন নেই, শুধু কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চেহারা দেখিয়ে বড় বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন অনেকেই।

দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের প্রায় সবাইকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদায়ন করেছে। এই প্রমোশনের খেলায় পিছিয়ে নেই থানার নেতারাও। পার্টিতে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছে সেইসব নেতাকর্মীরা যারা জিএম কাদেরের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। এ কারণে অনেকেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, অনেক সিনিয়র নেতা নাকি রওশন এরশাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন কো-চেয়ারম্যানও রয়েছেন। যারা রওশনকে পার্টির হাল ধরার জন্য অনুরোধ করেছেন। রওশনও নাকি জিএম কাদেরের এসব কর্মকাণ্ডে অনেকটা ক্ষুব্ধ।

সংশ্লিষ্টদের মতে জাতীয় পার্টির সার্বিক পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির কাণ্ডারি হওয়ার পাল্লা বেগম রওশন এরশাদের বেশি।

জাতীয় পার্টিও দলীয় একজন এমপি তার নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘জি এম কাদের তো প্রথম খেলায় হেরে গেছেন (বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিঠিতে ভুল)। ২৬ নভেম্বর জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান তার পদ হারাবেন।’