আজও চিহ্নিত হয়নি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের শহীদ হওয়ার স্থান

8
Spread the love

যশোর প্রতিনিধি।।
দেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠর যুদ্ধক্ষেত্র ও শাহাদৎ বরণের সাতটি স্থানের একটি যশোরে। এই রণাঙ্গনটি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গোয়ালহাটি-আটুলিয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই স্থানে অসীম সাহসিকতায় সম্মুখ সমরে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে সহযোদ্ধাদের প্রাণ রক্ষা করেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ। কিন্তু অবহেলা ও উদ্যোগ না নেওয়ায় সেই রণাঙ্গণের স্মৃতিটি মুছে যেতে বসেছে।

দু’দশক আগে সেখানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হলেও অন্তত একযুগ আগে তা বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়দের দাবি, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র শাহাদৎ বরণের স্থান ও যুদ্ধক্ষেত্রটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হোক, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় ভূমিকা রাখবে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৯৭১ এর ৫ সেপ্টেম্বর ছুটিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষার সামনে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে পাঁচ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। তবু পেট্রোলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এক সময়ে সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নেন এবং হাতের এল.এম.জি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করলে শত্রুপক্ষ পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে তার ডান কাঁধে।

ধরাশায়ী হওয়া মাত্র আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। হাতের এল.এম.জি সিপাহী মোস্তফাকে দিয়ে নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে বলেন এবং মোস্তফার রাইফেল চেয়ে নিলেন যতক্ষণ না তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন। সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সমানে গুলি ছুড়তে লাগলেন রক্তাক্ত নূর মোহাম্মদ।
এই অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের এমন ক্ষতিসাধন করেন যে তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী যোদ্ধাকে বেয়নেট দিয়ে বিকৃত করে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে। পরে প্রতিরক্ষার সৈনিকরা এসে পাশের একটি ঝাড় থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে।

এই বীরসেনানীকে পরবর্তীতে যশোরের সীমান্তবর্তী কাশিপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র সমাধিস্থল ঘিরে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হলেও তার যুদ্ধক্ষেত্র ও শহীদ হওয়ার স্থানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। বরং স্থানটি অবহেলিত ও ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, দু’দশক আগে সেখানে একটি স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করা হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তা বিলীন হয়ে গেছে।

এদিকে এই রণাঙ্গনের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর স্ট্যাটাস দেন কবি ও গবেষক সাইদ হাফিজ। স্ট্যাটাসে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র শাহাদৎ বরণের স্থানের স্মৃতি রক্ষায় নিজের জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক নিলামে বিক্রি করতে চান।

যশোরের ঝিকরগাছার সন্তান কবি ও গবেষক সাইদ হাফিজ স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘জাতীয় স্বর্ণপদক বিক্রি করতে চাই। গত ১০ বছর ধরে একটা বিষয় আমাকে মানসিকভাবে ব্যাপক যন্ত্রণা দিচ্ছে। কিছুতেই আমি এই লজ্জা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। মূল ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে ৫১ বছর আগে। ১৯৭১ সালের আজকের এইদিনে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলাধীন আটুলিয়া গ্রামে (বই-পুস্তকে গোয়ালহাটি উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে জায়গাটির নাম আটুলিয়া) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ। সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে অসম সাহসিক যুদ্ধে তিনি একা শত্রুপক্ষের এত বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধন করেন যে, তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী বীরযোদ্ধাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে দুই চোখ উপড়ে ফেলে এবং মাথা ফাটিয়ে ঘিলু ছড়িয়ে দেয়। পরে প্রতিরক্ষার সৈনিকরা এসে রাস্তার পাশের একটি কচুক্ষেত থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করেন।

কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার ৫১ বছর অতিবাহিত হলেও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ এর মৃত্যুস্থানে ন্যূনতম একটি স্মৃতিফলকও বসানো হয়নি। এমনকি যেখানে তিনি মারা গিয়েছিলেন সেখানে এখন গরুর গোবর ও ময়লা আবর্জনা ফেলা হয়। আমি গত ১০ বছর ধরে বিভিন্ন দপ্তরে ধরণা দিয়েছি, পরিচিত মহলের সবাইকে অবহিত করেছি। সবাই কথা দিয়েছেন কিন্তু কেউই বীরশ্রেষ্ঠ’র স্মৃতি রক্ষার্থে এগিয়ে আসেননি। তাই কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে, আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে চাচ্ছি। এজন্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ‘পল্লী উন্নয়ন ও প্রায়োগিক গবেষণায় বিশেষ অবদান’ এর জন্য আমাকে যে জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক- ২০১৮ দিয়েছিলেন সেটা উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে আমার ক্ষুদ্র প্রাপ্তি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আমার আফসোস মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু যুদ্ধে স্বজন হারানোর ব্যথা আমারও আছে। তাই নতুন প্রজন্মের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখাকে একান্ত কর্তব্য মনে করি।
যে বা যারা আমার স্বর্ণপদকটি কিনে বীরশ্রেষ্ঠর স্মৃতি রক্ষার কাজে অংশগ্রহণ করতে চান তাদেরকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ জানাচ্ছি, পাশাপাশি এ কাজে সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।’

তবে কবি সাইদ হাফিজ এই স্ট্যাটাস দেওয়ার পর ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল হক দাবি করে বসেন, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র শাহাদৎ বরণের স্থানে স্মৃতিফলক রয়েছে। কিন্তু সরেজমিন গিয়ে গোয়ালহাটি-আটুলিয়ার কোথাও কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পরে এসে ঘটনাস্থলটি গোয়ালহাটি না আটুলিয়া তা নিয়ে দু’রকম মতামত উঠেছে।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, শাহাদৎ বরণের স্থান যেটিই হোক সেখানে অন্তত একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হোক।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র শাহাদৎ বরণের স্থান ও যুদ্ধক্ষেত্রটির সন্ধানে ঝিকরগাছা উপজেলার ছুটিপুর বাজার থেকে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ সড়ক ধরে ব্যাংদাহর দিকে দু’কিলোমিটার যেতেই সেই যুদ্ধক্ষেত্রের স্পট দেখা গেলো। সড়কটির একপাশে গোয়ালহাটি; অপরপাশে আটুলিয়া। মূলত এই সড়কের পাশ থেকেই বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সড়কের ওপরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তার মাথার অংশবিশেষ।

আটুলিয়া গ্রামের বয়োজেষ্ঠ কৃষক কোরবান আলী জানালেন, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র বিধ্বস্ত (মাথার খুলি উড়ে যাওয়া, চোখ উপড়ানো ও নগ্ন) মৃতদেহটি তিনি নিজের গামছায় জড়িয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে প্রতিরক্ষা সৈনিকদের হাতে তুলে দেন। তিনি দাবি করেন মৃতদেহটি আটুলিয়ার পাশেই ছিল।

আটুলিয়া গ্রামের মৃত কাঠু বিশ্বাসের ছেলে ইরাদ আলী বলেন, যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর। তাদের ঘরের পেছনের অংশে জঙ্গলের মধ্যেই যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ শহীদ হন। সেখানে থেকে শত্রুপক্ষের সৈন্যরা তার মৃতদেহ সড়কের কাছে নিয়ে যায়।

তবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান দ্বিমত পোষণ করে বলেন, তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তিনি গোয়ালহাটি অংশে শহীদ হয়েছিলেন। ওই সড়কের পাশে অনেক আগে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হলেও তা এখন আর নেই।

যদিও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাজাহান আলী দাবি করেন, ওই সড়কের স্থানীয় বাসিন্দা মৃত নুর মোহাম্মদের বাড়ির পাশে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখর মরদেহ পড়ে ছিল। সেটি আটুলিয়ার মধ্যে।
আটুলিয়া পূর্বপাড়ার ডা. আব্দুস সাত্তার বলেন, আটুলিয়া, গোয়ালহাটি রাস্তার এপার-ওপার। তাই এ নিয়ে বিবাদ করার চেয়ে জরুরি একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স তৈরি করা হোক। সেখানে জায়গাও আছে। ফলে প্রশাসনের উচিত, সেখানে স্মৃতি কমপ্লেক্স তৈরির উদ্যোগ নেওয়া।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল হক বলেন, স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছিলেন, স্মৃতিফলকটি আছে। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো সেটি নেই। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এদিকে শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে রণাঙ্গনের সেই স্থান পরিদর্শনে যান ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল হক। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ’র ছেলে গোলাম মোস্তফা কামাল, সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, গঙ্গানন্দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান প্রমুখ।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ’র ছেলে গোলাম মোস্তফা কামাল জানান, অনেক আগে সেখানে একটি স্মৃতিফলক থাকলেও এখন আর নেই। স্মৃতিফলক আছে দাবি করায় আমিও ইউএনওকে বলেছিলাম সেটি সঠিক নয়। এরপর তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’র শাহাদৎ বরণের স্থান নিয়ে দুটি ভিন্নমত আছে। তবে সেটি রাস্তার এপাশ-ওপাশ। পরিদর্শনের পর ইউএনও মহোদয় বলেছেন সেখানে নামফলক সম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে দেবেন। তবে সেটি রাস্তার এপাশে অর্থাৎ গোয়ালহাটির মধ্যে।

এ বিষয়ে কবি ও গবেষক সাইদ হাফিজ বলেন, সরেজমিন পরিদর্শনে ইউএনও কোনো স্মৃতিস্তম্ভ পাননি। এখন একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যেহেতু স্থান নিয়ে দু’ধরনের বক্তব্য আছে, তাই জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাধ্যমে উচ্চতর কমিটির করে যথাযথ স্থান নির্ধারণ করে এটি নির্মাণ করা হোক। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পর এটি যেন ভুল স্থানে নির্মাণ না হয়।