বাগেরহাটে চলছে যত্রতত্র ভুগর্ভস্থ বালু উত্তোলন, হুমকীতে পরিবেশ

5
Spread the love

 

স্টাফ রিপোটার,বাগেরহাট।।

বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় যত্রতত্র অবৈধভাবে ভুগর্বস্থ বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নিয়ম নীতি ও আইনের তোয়াক্কা না করে সরকারি নদী, খাল ও জলাশয় থেকে এসব বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিনকে রুপান্তরিত করে স্থানীয়ভাবে তৈরি ড্রেজার মেশিন দিয়ে রাত-দিন নিরবিচ্ছন্ন বালু উত্তলন করা হয় বিভিন্ন এলাকায়। বালু উত্তোলনের ফলে একদিকে যেমন পার্শ্ববর্তী রাস্তা ও জমিতে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হচ্ছে। তেমনি বিকট শব্দে স্থানীয় পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। বিরক্ত হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। অভিযোগ রয়েছে বেশিরভাগ এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্র ছায়ায় এসব বালু উত্তোলন হয়।

শনিবার (২৭ আগস্ট) দুপুরে বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নের বড়বাসবাড়িয়া এলাকার পিচঢালা রাস্তা সংলগ্ন খালে দুটি ড্রেজার দিয়ে ভুগর্বস্থ বালু উত্তোলন করতে দেখা যায়। আব্দুল রসুলপুর গ্রামের ছ-বাকি খালে বসানো ড্রেজারটি ডেমা ইউনিয়ন পরিষদের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য রিপন কুমার মসিদের। এরপরে বড়বাসবাড়িয়া এলাকায় আন্ধারিয়া নদীর শাখা খালে বসানো ড্রেজারটির মালিক রামপাল উপজেলার ফয়লা এলাকার পলাশ নামের এক ব্যক্তি। এই ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন। শুধু ডেমা ইউনিয়ন নয়, বাগেরহাটের ৭৫টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভায় বিভিন্ন এলাকায় এভাবে আইন অমান্য করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ভুগর্বস্থ এসব বালু দিয়ে বেশিরবাগ ক্ষেত্রে নিচু জমি ভরাট করে উচু করা হচ্ছে। স্থান, এলাকা ও দূরত্ব ভেদে প্রতি ফুট বালু ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বালু বিক্রি থেকে প্রাপ্ত টাকার একটা অংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে ড্রেজার মালিকদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডেমা ইউনিয়নের এক বাসিন্দা বলেন, শুধু আব্দুল রসুলপুর ও বড়বাসবাড়িয়া নয়, আমাদের ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। এবিষয়ে কথা বললে প্রভাবশালীদের রোষানলে পরতে হয়। তাই ক্ষতি হলেও মুখ বুঝে সহ্য করতে হয় আমাদের।

বালু উত্তোলনকারী ও ড্রেজার মেশিনের মালিক ইউপি সদস্য রিপন কুমার মসিদ বলেন, সবাই উত্তোলন করে তাই আমিও মেশিন বানিয়েছি। চুক্তি করে বালু উত্তোলন করছি। সামান্য লাভ হয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্যার ফোন দিয়েছিল বন্ধ করে দিয়েছি।

ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এই বালু দিয়ে আমার বাড়ি উচু করছি না। বালু দিয়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট করছি। যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতে পারে। মাঠ ভরাট হলে মেশিন বন্ধ করে দিব।

বিভিন্ন গবেষনা রিপোর্ট অনুযায়ী বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের নানা ক্ষতি হয়। এর মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলে নেতিবাচক পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানি ও বায়ুদূষণ হওয়ারমত ঘটনা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের সময় সৃষ্ট বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি তাদের খাদ্যের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মৎস্য প্রজনন-প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি চাষাবাদের জমিও নষ্ট হচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ভুগর্বস্থ বালু উত্তোলনের সব থেকে বড় যে ক্ষতি হয় সেটা হচ্ছে প্রাকৃতিক ভূচিত্র নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ওই এলাকার জনজীবনের উপর স্থায়ী বিরুপ প্রভাব পরে। ভুগর্বস্থ বালু উত্তোলন বন্ধ না করা গেলে বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর অনেক বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে দাবি করেন তিনি।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ধারা ৫-এর উপধারা ১ অনুযায়ী, পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। ধারা ৪-এর (খ) অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব আইনের কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করেছি। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে অভিযান অব্যাহত থাকবে। অভিযান চালিয়ে ভুগর্বস্থ বালু উত্তোলনকারীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।