প্রতিদিন সকালে চায়ে রক্ত চুমুক!

1

হঠাৎ করে আলোচনায় চা শ্রমিকরা। মজুরি ৩০০ টাকার দাবিতে তাদের আন্দোলনে টনক নড়েছে আমাদের। কিন্তু এই শ্রমিকরা প্রায় দুইশত বছর যাবৎ এই রকম মানবেতর জীবন যাপন করছে। একজন চা শ্রমিকের দৈনিক বেতন যদি ১২০ টাকা হয় তারা কিভাবে বেঁচে থাকে এই বিষয়টি রাষ্ট্র, আমাদের সুশীল সমাজ কোনদিন খতিয়ে দেখেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে কোন রাজনৈতিক দল তাদের বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি। তাদের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেনি। চা শ্রমিকদের ইতিহাস দাসত্বের ইতিহাস। কৃতদাসের ইতিহাস। একটি আধুনিক সভ্য বিশ্বব্যবস্থায় আমরা সামন্তযুগের আদর্শ পালন করে যাচ্ছি। যা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক।

হতভাগ্য চা শ্রমিকদের ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩০ এর দশকে সুন্দর জীবনযাত্রার লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশে এনেছিল চা কোম্পানীর মালিকরা। কম দামে শ্রম কিনে অধিক মুনাফা অর্জন করার লক্ষ্যে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে ভারতের বিহার, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কানু, তেলেগু, লোহার, রবিদাস, গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। তাদের বলা হয়েছিল-গাছ নাড়লেই টাকা পাবে। কিন্তু চা-শ্রমিকরা এ অঞ্চলে এসে দেখে, গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা; হিংস্র জীবজন্তুর প্রতিকূল পাহাড়-জঙ্গলময় পরিবেশে নিজের জীবন বাঁচানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার। অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হয় তারা।

ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তানের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। মৌলিক অধিকারও তারা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। নিজের অধিকার নিয়ে যেনো সোচ্চার না হতে পারে সেজন্য মালিকপক্ষের সহযোগিতায় কিছু অফিসার তাদের তদারকি করে। চা বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনও ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি। একরকম দাসের মতো জীবন কাটালেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উৎপাদন ধরে রেখেছেন চা শিল্পীরা। ২০১০ সালে মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪৮ টাকা নির্ধারণ করে। প্রতি পাঁচ বছর পর শ্রমিকদের মজুরি নতুন করে নির্ধারণ করার কথা থাকলেও মজুরি বোর্ড তা করেনি। তাই মালিকপক্ষের সাথে প্রতি দুই বছর পর পর চুক্তির মাধ্যমে ৪৮ টাকা থেকে ১২০ টাকায় মজুরি উন্নীত করে চা শ্রমিকরা। কিন্তু এখন এই দুর্মূল্যের বাজারে ১২০ টাকায় তিনবেলা না খেয়েও বাঁচা দায়!
আমরা মনে করি সরকার যে ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করেছে তা শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ট নয়। এতে করে একটি পরিবার বেঁচে থাকতে পারে না। তার ওপর তাদের নেই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবাসমূহ। বিদ্যমান বাস্তবতায় দৈনিক একটি পরিবার ১৪৫ টাকায় চলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে চা শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিলেও আমরা মনে করি চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা করে সরকার তার উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।