বিশেষ প্রতিনিধি।।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার জেলা হিসেবে পরিচিত নড়াইলের দুটি সাম্প্রদায়িক ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। প্রথম ঘটনায় সনাতন ধর্মাবলম্বী কলেজ অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোর ক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতাদের দায়ী করছে সংগঠনেরই একটি অংশ। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা কলেজ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা পেতে এই নিন্দনীয় কাজে জড়িয়েছেন। আর লোগাগড়ার দীঘলিয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায়ও দলটির একটি অংশের মদত, অন্তত তাঁদের নিষ্ফ্ক্রিয়তার কথাও জোরেশোরেই আলোচিত হচ্ছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলার মতো মনস্তাত্ত্বিক বিষয় দুটি ঘটনায় ভূমিকা রেখেছে বলে নিজেদের দলকেই কাঠগড়ায় তুলছেন নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় নড়াইলের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজাও দলীয় প্রতিপক্ষের সমালোচনা করেছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধেও সমালোচনা আছে যে, তিনি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার দল আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্যও এ জেলায়। তা সত্ত্বেও হঠাৎ করেই কেন সেখানে সংখ্যালঘুরা টার্গেট হলেন- তা নিয়ে আলোচনাকালে ক্ষমতাসীন দলটির স্থানীয় পর্যায়ের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন এলাকাবাসী। সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মুখেও একই অভিযোগ। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সাংগঠনিক কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা, তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতা ও সংসদ সদস্যের দূরত্বের কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না দলটি।
মহানবীকে (সা.) নিয়ে কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়েছে এমন প্রচরণার পটভূমিতে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়া বাজার ও বাজার-সংলগ্ন সাহাপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, দোকানপাট ও মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তরুণ সাহা ও তাঁর ভাই কুমারেশ সাহাকে পিটিয়ে জখম করে দুস্কৃতকারীরা। হামলাকারীদের হাতে আহত হন স্থানীয় ইউপি সদস্য জান্নাত মৃধা ও আওয়ামী লীগ কর্মী বনিরুল ইসলাম। এ ঘটনায় গ্রাম ছেড়ে পালানো সাহাপাড়ার দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর কেউ কেউ এখনও বাড়িতে ফেরেননি।
এর আগে গত ১৮ জুন নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর আদর্শ কলেজে তাণ্ডব চালানো ছাড়াও অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো হয়। ঘটনার পর থেকে লোকলজ্জা ও প্রাণভয়ে অধ্যক্ষ এলাকা ছেড়েছেন। নিরাপত্তার অভাবে এক মাসেরও বেশি সময় বন্ধ কলেজটি।
ঘটনা দুটির পর নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দেশজুড়ে। বিশেষ করে দীঘলিয়ার ঘটনার সময় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ফ্ক্রিয়তা এবং শাসক দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ। তাঁরা বলছেন, যে ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে এত তুলকালাম, পুলিশ সেটা জানতে পেরেছিল আগেই।
তাহলে তাদের মোকাবিলা করতে যথাযথ প্রস্তুতি কেন ছিল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর? অন্যদিকে, সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক হামলা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার ক্ষেত্রেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ব্যর্থ বলে এলাকাবাসীর মন্তব্য।
এ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের কণ্ঠেও এ নিয়ে ক্ষোভের সুর। ঘটনার পরদিন এলাকা পরিদর্শনে এসে সংসদ সদস্য তারকা ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা জাতীয়ভাবে দৃষ্টি কেড়েছন, কারণ কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের রামু থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা প্রভৃতি বহু যায়গার অনুরূপ ঘটনায় সংসদ সদস্যরা এমন ভূমিকা রাখেননি। তবে এদিন দীঘলিয়ায় মুর্তজা বলেন, ‘আমার লজ্জা হচ্ছে, আজকে যখন মাশরাফি এসে দাঁড়িয়েছে, তখন সবাই ছবি তুলতে চলে এসেছে। কালকে যদি এই লোকগুলো এসে দাঁড়াত, তাহলে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটত না।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নড়াইলে দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর জেলা ও উপজেলা কমিটি আছে, আছেন জনপ্রতিনিধিও। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের তেমন যোগাযোগ নেই। দীর্ঘদিন ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন বা কমিটি পুনর্গঠন হয় না। নির্দিষ্ট কিছু দিবস পালনে দায়সারা কর্মসূচির মধ্যে দলীয় কার্যক্রম বন্দি হয়ে পড়ায় ঝিমিয়ে গেছে সাংগঠনিক তৎপরতা।
নড়াইল আওয়ামী লীগে দু’পক্ষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিষয়টিও এখন ওপেন সিক্রেট। গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, সাবেক সভাপতি সোহরাব বিশ্বাস ও নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি একপক্ষে। অন্যপক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান নিলু ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা।
সাধারণ কর্মীদের অভিযোগ, জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরোধের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল পর্যায়েও। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ঘিরে অধিকাংশ এলাকায় নেতাকর্মী দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কলেজ অধ্যক্ষকে গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনা যে ইউনিয়নে ঘটে, সেই মির্জাপুরে ভোটের আগে আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে শুরু হওয়া সংঘাত এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। গত শুক্রবার সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার লোহাগড়ার দীঘলিয়া ইউনিয়নেও দুই গ্রুপের বিরোধ প্রকট।
দুটি ঘটনার কোনোটির ব্যাপারে দলীয়ভাবে তারা এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেনি। দীঘলিয়ায় হামলার পরদিন স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পৃথকভাবে ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন। অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র দাবি করেন, দলের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য কেউ তাঁকে কিছুই জানাননি। ফলে তিনি নিজের মতো করে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান।
দীঘলিয়ায় হামলার ঘটনায় দু-একজন নেতার ভূমিকা প্রশংসা কুড়ালেও দলটির সার্বিক তৎপরতা নিয়ে স্থানীয়দের মনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সাহাপাড়া সর্বজনীন রাধা গোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা বলেন, স্থানীয় লোকজন এবং আশপাশের মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল ও ভাঙচুর করে। এ সময় স্থানীয় দীঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ বোরহান উদ্দিন, ইউপি সদস্য জান্নাত মৃধা, আওয়ামী লীগ নেতা বনিরুল ইসলামসহ কয়েকজন হামলাকারীদের ঠেকাতে চেষ্টা করেন। তবে বিক্ষোভের নামে হামলা-লুটপাটকারীদের তুলনায় তাঁরা খুবই কম ছিলেন। ঘটনার পর সবাই এসেছেন। পুলিশ এসেছে আরও দেরিতে।
সাহাপাড়ার গোবিন্দ সাহা বলেন, সন্ধ্যায় কয়েকশ মানুষ তার বসতঘর ভাঙচুর করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনার পর অনেকেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু হামলার সময় এগিয়ে এসেছেন হাতেগোনা দু-একজন নেতা।
স্কুল শিক্ষক পলাশ সাহা বলেন, হামলাকারীরা বাজারে জড়ো হয় বিকেলের আগে থেকেই। আর তাঁদের বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে মাগরিবের আজানের পর। হামলার খবর পেয়ে প্রতিবেশীসহ সবাই ছুটে এসেছেন সাহায্য করতে। তবে হামলার আগেই যদি নেতারা চলে আসতেন, তাহলে হয়তো দুস্কৃতকারীরা সাহস পেত না।
তবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ওহিদুর রহমান দাবি করেন, দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে পরিস্থিতি ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। হামলায় জড়িতরা সবাই এলাকার বাইরের।
এদিকে, নড়াইলের দুটি ঘটনায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারাও। ঘটনাগুলোকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বলে মানতে নারাজ তাঁরা। উভয় ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, মির্জাপুর কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য নির্বিঘ্ন করতে অধ্যক্ষকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে কয়েক নেতা। তারাই পরিকল্পিতভাবে অধ্যক্ষকে হেনস্তা করেছে। একইভাবে লোহগড়ার দীঘলিয়া সাহাপাড়ার বাসিন্দারা সবসময় জোটবদ্ধভাবে ভোট দেয়। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে যারা ওই গ্রামবাসীর ভোট পায়নি, তারাই সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছে।
তিনি বলেন, নড়াইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। ত্যাগী ও সংগ্রামীদের বাদ দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য মাশরাফিরও হস্তক্ষেপ ছিল। এখন এরই খেসারত দিতে হচ্ছে।
জেলা-উপজেলা কমিটি ছাড়াও সব ক্ষেত্রেই মাশরাফির হস্তক্ষেপ রয়েছে উল্লেখ করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বলেন, দীঘলিয়ায় হামলা হঠাৎ করে ঘটেনি। ইউপি নির্বাচন নিয়ে সেখানে তাঁদের দলে বিরোধ রয়েছে।
দীঘলিয়া হামলার পর সংসদ সদস্য মাশরাফির একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়। ওই পোস্টে জেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রতিপক্ষের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘সামনে থেকে আঘাত করুন। আমার সঙ্গে সরাসরি লড়াই করুন। আমি সাধুবাদ জানাব। পেছন থেকে আঘাত করতে করতে আপনারা ক্লান্ত হয়ে যাবেন। আমাকে ভোগানোর জন্য দয়া করে সাধারণ ও অসহায় মানুষদের আর ক্ষতি করবেন না। মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিন, লড়াই আমার সঙ্গে করুন। আমি জানি, নড়াইলে রাজনীতি যাদের কাছে পেশা, তাদের কাছে আমি এখন নেশা।’
পোস্টে তিনি ইঙ্গিত করেছেন, বছর দুয়েক আগে তাঁর শ্বশুরবাড়ি এলাকায় হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে তাঁকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়। গত ১৮ জুন নড়াইল সদরের মির্জাপুর কলেজে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায়ও তাঁকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সর্বশেষ দীঘলিয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার মাধ্যমে তাঁকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাশরাফি বলেন, ‘সময় এলে সবকিছু খোলাসা হয়ে যাবে।’
তবে মাশরাফির ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা সুবাস চন্দ্র বলেন, ‘এটা তাঁর ভ্রান্ত ধারণা। অতীতে আমাদের মতো লোকদের দলের জন্য যত ত্যাগ-শ্রম থাকুক না কেন, এখন (দলের) উপর মহলে তাঁর গুরুত্ব অনেক বেশি। তাহলে কী কারণে তাঁকে কেউ ফাঁসাবে?’
এদিকে, নিজ নির্বাচনী এলাকায় সংসদ সদস্য মাশরাফিকে নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি এলাকায় খুব একটা থাকেন না। মাঝেমধ্যে নড়াইলে এলেও বেশিরভাগ সময় কাটান জেলা শহরেই। কখনও গ্রামে গেলেও চলেন ভিআইপি কায়দায়। তাঁর সান্নিধ্য তেমন পান না দলের তৃণমূল কর্মী ও সাধারণ মানুষ।-সমকাল