দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক সামছুদ্দিন// ফল-পাতা খেয়ে লড়াই করেছেন দিনের পর দিন

2
Spread the love

যশোর অফিস।।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতীয় পূর্ববাংলার অনেক সৈনিক রেখেছিলেন বীরত্বপূর্ণ অবদান। তাদের কয়েকজন স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরেছেন কাছে। ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে আজ রইলো কে কে সামছুদ্দিনের গল্প।

খাতাকলমে কে কে সামছুদ্দিনের বয়স এখন ৯৮। যশোর শহরের পুরাতন কসবা বিবি রোড (মাদ্রাসা মহল্লা) এলাকায় থাকেন মেয়ের জামাই আবুল হোসেনের বাড়িতে। নামাজ, পবিত্র কোরআন আর বই পড়ে সময় কাটে তার।

বছরখানেক আগেও বেশ চটপটে ছিলেন সামছুদ্দিন। এখন বার্ধক্যে বেশ কাহিল। স্মরণশক্তিও কমে গেছে। কথা জড়িয়ে যায়। নাতির ছেলে বোরহানউদ্দিনই তার দেখাশোনা করেন।

শতবর্ষী সামছুদ্দিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর সৈনিক ছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার করেছেন দুর্বিষহ সময়। যুদ্ধে সাহসিকতার জন্যে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন পদক। তবে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার সেসব পদক, যুদ্ধদিনের স্মারক ও ছবি— সবই নষ্ট করে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এমনটাই জানালেন সামছুদ্দিনের বড় ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা।

৮ জুলাই এই বীরযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বেশিরভাগ কথাই বোঝা যাচ্ছিল না। তবে আকারে-ইঙ্গিতে এবং অস্পষ্ট উচ্চারণে বোঝা গেলো অনেক কিছু।

যুদ্ধকালে খাকি পোশাক আর মাথায় পাগড়ি পরতেন সামছুদ্দিন। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ লড়াই করেছেন। বশ্যতা স্বীকার করিয়ে ছেড়েছেন জাপানিদের। খাবারের কষ্ট ছিল বেশ। চালিয়েছেন মেশিনগান-স্টেনগান। জানালেন ভাঙা ভাঙা স্বরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষে লড়াই করা বাংলাদেশি (তৎকালীন পূর্ববাংলা) সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছেন তারা। রসদ সরবরাহ থেকে শুরু করে সম্মুখসমরেও বড় ভূমিকা রয়েছে তাদের।
কে কে সামছুদ্দিনের বড় ছেলে বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর গোলাম মোস্তফা বলেন, বাবার মুখে শুনেছি তিনি সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে লড়াই করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে লড়াই চলাকালে কখনও দুদিন, কখনও চার দিন পর্যন্ত সামান্য খাবার কিংবা শুধু পানি খেয়ে থাকতে হয়েছিল। বনের পাতা বা ফল খেয়ে যুদ্ধ করেছেন দিনের পর দিন।

গোলাম মোস্তফা বলেন, সার্টিফিকেট অনুযায়ী আব্বার জন্ম ১৯২৪ সালের ১০ জুন, ভারতের কেরালায়। তার দাদার রাবারের বাগান ছিল হাজার বিঘা জমিতে। ছোটবেলায় তার মা (দাদি) মারা গেলে দাদা আরেকবার বিয়ে করেন। বাবার মুখে শুনেছি- তিনি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র; ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলেন। একদিন সৎ মায়ের বকাঝকা ও বাবার খারাপ আচরণের কারণে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে মাদ্রাজের এক মামার বাড়ি চলে যান। এরপর ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে সৈনিক পদে যোগ দেন। তার সৈনিক নম্বর ৬৪১৪৬০।

তিনি জানান, যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাবা যুদ্ধের ময়দানেই ছিলেন। দেশভাগের পর তিনি বাংলাদেশে স্থায়ী হন। কিছুকাল পরই সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।

এরপর যশোর সদরের দোগাছিয়া গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু। কে কে সামছুদ্দিনের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। আরেক ছেলে দোগাছিয়া গ্রামেই থাকেন, কৃষিতে সম্পৃক্ত তিনি। স্ত্রী জাহেদা খাতুন মারা গেছেন ১৯৯৯ সালে।

বিশ্বযুদ্ধে অবদান ও ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভাতা-সহায়তা পাচ্ছেন অনেকে।

মো. গোলাম মোস্তফা জানান, তিন মাস পর পর ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকা এবং সেনাবাহিনী থেকে প্রতি মাসে কিছু পেনশন পান তার বাবা।

তিনি আরও জানান, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে বিশ্বযুদ্ধে লড়াইকারীদের মধ্যে সামছুদ্দিনসহ ৯ বাংলাদেশি সৈনিক এখনও বেঁচে রয়েছেন। যারা জীবিত আছেন এবং যারা ইতোমধ্যে মারা গেছেন— তাদের জন্যে বাংলাদেশ সরকার কিছু স্মারকের ব্যবস্থা করতে পারে। কেননা ওই সময় বাংলাদেশের মতো জায়গা থেকে কেউ যুদ্ধে যাবে, এটা অকল্পনীয় ছিল। তাদের স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে আগামী প্রজন্ম তাদের বীরত্বের কাহিনি জানতে পারবে।

১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫-এর পুরো সময়ই যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন কে কে সামছুদ্দিন। যুদ্ধ চলাকালে একবার সিঙ্গাপুরে তিন হাজার সহযোদ্ধাসহ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। ওই অবস্থাতেই তিন মাস যুদ্ধ চালিয়ে যান তারা।

অনেক সময় কেটেছে না খেয়ে। আত্মসমর্পণের আহ্বান উপেক্ষা করে তার ইউনিট জাপানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। বিশ্বযুদ্ধের পরও সেনাবাহিনীর চাকরিতে ছিলেন সামছুদ্দিন।