ভরা বর্ষায় পুড়ছে দেশ, প্রভাব ফেলতে পারে জনস্বাস্থ্য ও খাদ্যে

1
Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি।।
ক্যালেন্ডারের হিসাবে এখন শ্রাবণের শুরু। ভরা বর্ষা মৌসুম। এই সময়ে মুষলধারে বৃষ্টি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা নেই তার। বরং কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া যেন রূদ্রমূর্তি ধারণ করে আছে। তাপমাত্রার পারদ প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। আর এর মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা আবহাওয়া অধিদফতরের।
এদিকে, ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। যদিও বৃষ্টির পূর্বাভাসও রয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে যে পুঞ্জিভূত মেঘ বাংলাদেশে অবস্থান করার কথা তা ভারতে অবস্থান করছে। যে কারণে বর্ষাকালেও বৃষ্টির দেখা নেই। পরিবেশবিদদের মতে, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকির মুখে পরতে পারে, তেমনি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও। আবহাওয়া অধিদফতরের মতে, যদি টানা তিন দিন অন্তত ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করে তাহলে তাকে তাপপ্রবাহ বলে। যা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ছয়টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) আবহাওয়া অধিদফতরের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী এবং চুয়াডাঙা জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে দিন শেষে কিছু কিছু এলাকায় এই তাপপ্রবাহ প্রশমিত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ফলে শীতকালেও গড় তাপমাত্রা বেশি থাকছে। বর্ষাকালে যেভাবে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘তাপমাত্রা সাধারণত এমেই থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে বৃষ্টির কারণে গরম কম অনুভূত হয়। এবার একেবারেই বৃষ্টি না থাকায় তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে যে পুঞ্জিভূত মেঘ বাংলাদেশে অবস্থান করার কথা সেটা নেই। যে কারণে বৃষ্টি কম হচ্ছে।’
আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে দেশের খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলে সবচেয়ে তাপমাত্রা বেশি বিরাজ করছে। এই দুই অঞ্চলের কোথাও কোথাও টানা এক মাসেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি। এর পরে রয়েছে উত্তরের জেলা রংপুর ও দিনাজপুর। এখনো রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বিরাজ করছে। এছাড়া ওই বিভাগের ঈশ্বরদীতে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বদলগাছী এবং তাড়াশে যথাক্রমে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর বগুড়ায় ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগের সর্বোত্র তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
এর পরে সৈয়দপুরে রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ ডিগ্রি এবং রংপুরে ৩৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাশাপাশি তেঁতুলিয়া, ডিমলা, রাজারহাটে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এছাড়া এদিন দিনাজপুরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে খুলনা বিভাগে এদিন তাপমাত্রা সামান্য কমের দিকে। কিন্তু বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। আর রাজধানী ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
একদিকে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, অন্যদিকে বৃষ্টি না হওয়ায় দেশের অনেক এলাকার কৃষিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বৃষ্টির অভাবে আমন ক্ষেত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কথা হয় রাজশাহীর গোদখালি এলাকার কৃষক মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, টানা খরা থাকায় সেখানকার অনেক জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমন চারার বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক চারা নষ্ট হয়ে গেছে। গরমে নার্সারির ফুল ঝড়ে যাচ্ছে। সব সময় সেচ পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সরকার নির্দেশনা জারি করেছে।’
একই বিষয়ে কথা হয় খুলনার বাগেরহাটের এক কৃষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা তো কৃষক। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাঠে কাজ করতে হয়। তীব্র রোদ আর গরমে মাঠে কাজ করা কঠিন হয়ে গেছে। খাল ও নদীর চারপাশের জমিগুলোর ফসল পানি দিয়ে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে। কিন্তু যেসব জমিতে সহজে পানি পৌঁছানো সম্ভব না সেসব জমির ফসল টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

পরিবেশবিদদের মতে, এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জানান, তীব্র গরমে কিছু ভাইরাস উপযুক্ত পরিবেশ পায় এবং দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। পানিবাহিত রোগের পাশাপাশি নতুন নতুন রোগ ছড়াতে পারে।

তিনি বলেন, ‘এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এর খারাপ প্রভাব পড়বে জীব বৈচিত্রের ওপর। চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও।’ তিনি আরও বলেন, ‘তীব্র গরমে বাতাসের স্বাভাবিক গতি প্রবাহে পরিবর্তন এসেছে। এর প্রভাব পড়ছে চাষাবাদে। এখন আমনের ভরা মৌসুম। বীজ রোপনে প্রচুর বৃষ্টির দরকার। এই তাপমাত্রায় সেসব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

তীব্র গরমে গ্রামের মতো শহরেও নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। তারমধ্যে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। হাটখোলা এলাকার বাসিন্দা সুখরঞ্জন মজুমদার বলেন, ‘তিনটা থেকে বিদ্যুৎ নেই। যদিও রেশনিংয়ের খবর আগেই বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানিয়ে দিয়েছিল। গ্রামে গাছ-গাছালির নিচে বিশ্রাম নেওয়ার উপায় থাকলেও শহরে সে পরিস্থিতি নেই। অনেক বাসা বাড়িতে জানালা খোলার পরিস্থিতিও থাকে না। আমাদের জন্য এই গরম দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।’

তাপমাত্রা শুধু বাংলাদেশেই বাড়ছে না। গোটা বিশ্ব তীব্র তাপদাহে পুড়ছে। লন্ডনে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ায় রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। স্পেন, পুর্তগালের তাপমাত্রা উঠেছে ৪৭ ডিগ্রি পর্যন্ত। যা বৈশ্বিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী সাহারা মরুভূমির কিছু অঞ্চলের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি।

আবহাওয়ার এই পরিস্থিতির মধ্যেই আবার দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতেরও পূর্বাভাস রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে।

আবহাওয়ার এই দ্বিমুখী আচরণ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে আকাশে মেঘ একত্রিত হতে পারে না। কারণ এ সময় বাতাসের গতি কম থাকে। তীব্র গরমে মেঘের পানি বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ার আগেই বাস্প হয়ে যাচ্ছে।’