মায়ের এক ফোঁটা দুধও মুখে যায়নি, ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে শিশুটি

2
Spread the love

খুলনা রিপোর্ট।।

পৃথিবীর আলো দেখার পর নবজাতকের জন্য মায়ের বুকের দুধ মহৌষধ। কিন্তু সড়কে জন্ম নেওয়া শিশুটির ভাগ্যে মায়ের বুকের এক ফোটা দুধও জোটেনি। দুধের জন্য ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে জন্ম নেওয়া সেই নবজাতক।

প্রাইভেট হাসপাতালের কেবিনে শিশুটি যখন কেঁদে উঠছে তখন ড্রপার দিয়ে অন্য মায়ের বুকের দুধ মুখে তুলে দিচ্ছেন নার্স। কয়েক ড্রপ দুধ খেয়েই কান্না থামছে। চিকিৎসকরা জানান, অন্তত দুই সপ্তাহ লাগবে শিশুটি সুস্থ হতে।

রোববার দুপুরে ময়মনসিংহ নগরীর চরপাড়া মোড় এলাকায় লাবিব প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পরিচালকের কক্ষে বসা শিশুটির দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু। সমাজসেবা বিভাগের প্রবেশন অফিসার আসাদুজ্জামান ও কর্মী আবদুল্লাহ সুমন নানা তথ্য নিচ্ছেন শিশুটির দাদার কাছ থেকে। প্রয়োজনীয় সব সহায়তা সমাজসেবা বিভাগের পক্ষ থেকে করার আশ্বাসও দেওয়া হয়।

ডান হাতের হাড় ভেঙে যাওয়ায় শিশুটি অর্থোপেডিকসের সার্জন ডা. সোহেল রানা ও কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সার্বক্ষণিক দেখভাল করছেন সিনিয়র নার্স সুরাইয়া ইয়াসমিন ও নার্স শরিফা আক্তার।

বেসরকারি এই হাসপাতালে নগরীর দাপুনিয়া কানাপাড়া গ্রামের আলমাসের স্ত্রী নাছিমা বেগম ৫ দিন আগে সন্তান প্রসব করেন। তার বুকের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে ত্রিশালে দুর্ঘটনার সময় জন্ম নেওয়া মেয়ে শিশুটিকে।

সিনিয়র নার্স সুরাইয়া ইয়াসমিন বলেন, শিশুটি খাবার ও পায়খানা করার সময় কান্নাকাটি করে। বাকি সময় খুবই শান্ত। অলৌকিকভাবে জন্ম হওয়া শিশুটির সেবা করতে পেরে তারও ভালো লাগছে।

লাবিব হাসপাতালের মালিক মো. শাহ জাহান জানান, শিশুটি পুরোপুরি সুস্থ হতে ১৫ দিন লাগতে পারে। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব ব্যয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বহন করছেন। তাকে অন্য মায়ের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। শিশুটিকে সুস্থ করে তোলার জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, শিশুটির চিকিৎসাসহ সব দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। একটি ব্যাংক হিসাবও খোলা হবে যেখানে সহযোগিতা পাঠানো যাবে। এছাড়া পুরো পরিবারটির জন্য স্থায়ীভাবে কী করা যায় সে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।


শিশুটির দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তিনি বলেন, ‘চা বিক্রি করে সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছি। ছেলে শ্বশুরবাড়িতে ঘর তুলে থাকতো। তার মৃত্যুতে আমাকে দেখারও আর কেউ রইল না।’

গত শনিবার দুর্ঘটনার শিকার দম্পতি ও তার মেয়ে সন্তানকে যে স্থানে কবর দেওয়া হয়েছে সেখানে আগেও আরও চারটি কবর ছিল। তার মধ্যে দু’জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। একটি পরিবারে বারবার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় পুরো এলাকায় শোক বইছে।

২০০৪ সালে উপজেলার রায়মনি গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও সুফিয়া বেগম দম্পতির ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ছেলে সামছুল আলম মিল থেকে ধান ভাঙিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে বাড়ির অদূরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান। ১৮ বছর পর ওই দম্পতির বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না আক্তার ও ছয় বছরের নাতনি সানজিদা আক্তার ওই একই সড়কের ত্রিশাল পৌরশহরের কোর্ট ভবন এলাকায় শনিবার দুপুরে ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান। ট্রাক প্রাণ কেঁড়ে নিলেও গর্ভবতী মায়ের পেট ফেঁটে বেরিয়ে আসে এক নবজাতক। পৃথিবীর আলোর দেখতে পারলেও ওই নবজাতক দেখতে পায়নি মা-বাবার মুখ। জামায়ের এক ফোঁটা দুধও মুখে যায়নি, ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে শিশুটিহাঙ্গীর আলম ও রত্না আক্তার দম্পতির জান্নাত (৮) ও এবাদুল্লাহ (৫) নামে দুই সন্তান রয়েছে।

এরআগে, ১৯৯৫ সালে মোস্তাফিজুর রহমান বাবলুর ভাই ফজলুল হক একই মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান।

শনিবার রাতে জাহাঙ্গীর, রত্না আক্তার ও তাদের মেয়ে সানজিদার দাফন সম্পন্ন হয়। তিনজনের কবরের পাশে আহাজারি করছেন স্বজন-প্রতিবেশীরা।

সড়কে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনি নিহত হওয়ার ঘটনায় মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু বাদী হয়ে ত্রিশাল থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ট্রাকের চালককে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাঈন উদ্দিন।