মাত্রাহীন শব্দে দূষিত নগরজীবন

3
Spread the love

-জিনাত আরা আহমেদ

শব্দ ছাড়া সফল যোগাযোগ সম্ভব না। ভাষার মূলে রয়েছে শব্দ। উচ্চারণের বিভিন্নতায় শব্দের মাত্রাজ্ঞানে ভাষা অর্থবোধ হয়ে উঠে। কথা আর ভাষাই শুধু নয় যন্ত্রের নিজস্ব পরিচয়কে তুলে ধরতে শব্দ বহু রুপ নিয়ে হাজির হয় ঘরে-বাইরে, পথে-প্রান্তরে, জনবসতিতে। শব্দহীন পৃথিবী যেমন অস্তিত্বহীন তেমনি মাত্রাতিরিক্ত শব্দের দাপটে আজ আমরা যেন উপায়হীন। শব্দের মাত্রা দিনে দিনে মাত্রাহীন। প্রতিটি রাস্তা অলিগলিতে হাইড্রোলিক হর্ণের শব্দ। মোটরসাইকেলে অসহনীয় মাত্রায় হর্ণের শব্দ কর্ণকুহরে পৌছে যায়। ইজিবাইকেও একই অবস্থা। ইঞ্জিন রিকশায় ব্যবহার হচ্ছে উচ্চশব্দের হর্ণ। এহেন শব্দ মাত্রার দূষণ রোধে উদাসী নাগরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ আজ সময়ের দাবি।

ক্রমবিকাশমান সভ্যতায় মানুষের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। উন্নয়নের ক্রমপ্রসারে নগর,শহর,বন্দর শুধু নয় গ্রামগঞ্জেও এখন ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগের পায়েচলা যানগুলো এখন অপসৃয়মান। নদীপথে চলাচলেও আর দেখা যায় না পালতোলা নৌকায় দাঁড়ি-বৈঠা হাতে মাঝিদের। দালানকোঠা-ঘরবাড়ি তৈরিতে যন্ত্রের ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ছে। মানববসতি সর্বদাই শব্দের ভারে প্রকম্পিত। সুনশান নীরবতায় একনিষ্ঠ মনোযোগ কিংবা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবকাশে প্রশান্তির নিদ্রা প্রায়শঃ স্মৃতিরোমন্থন।

সর্বক্ষেত্রে শব্দ দূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। কোন কোন জায়গায় দূষণের মাত্রা বেড়েছে দেড়গুনেরও বেশী। শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা গড়ে ৬০ ডেসিবেল হলেও শহরের অনেক জায়গায় এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবল পর্যন্ত উঠছে। হর্ণের মাত্রা সীমাহীন শুধু নয়, এর ব্যবহারে যারা নিয়োজিত তাদের মাত্রাজ্ঞানে বিস্ময় জাগে। মোটরবাইক চালক একজন শিক্ষিত লোক নিঃসন্দেহে। কিন্তু যানজটে আটকে থাকা অসংখ্য যানের পিছনে থেকে তিনি ক্রমাগত উচ্চমাত্রার হর্ণ বাজিয়ে চলেছেন। ইজিবাইকের চালক নিজের উপস্থিতি জানাতে নির্দিষ্ট বিরতিতে হর্ণ বাজাচ্ছেন। বড়ত্ব প্রকাশে বিলম্ব না করে হঠাৎ প্রাইভেট কারও একটানা হর্ণ দিয়ে বসে আছেন। বাহনের ভদ্র-শিক্ষিত বিভিন্ন বয়সের আরোহী কারো মুখে প্রতিবাদের চিহ্ন নেই। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন বিবিধ মাত্রার অসহনীয় শব্দের মাঝে, যেন ব্যতিক্রমী ভঁূঁভূঁজেলা বাঁশিতে মোহাচ্ছন্ন।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবলের বেশি হলেই তা দূষণ। আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের সব্বোর্চ সহনীয় মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে তা ৭০ ডেসিবেল। ২০১৮ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকায় সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবেলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাতেও এই মাত্রাকে সব্বোর্চ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু শব্দ দূষণ নিয়ে কড়াকড়ি আইন থাকলেও সবক্ষেত্রে এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে শব্দমান মাত্রার দ্বিগুণের বেশি দূষণ হচ্ছে। শব্দ দূষণের ৮০ শতাংশই হয় গাড়ির হর্ণ থেকে। ৩০ শতাংশ গাড়িতে লাগানো আছে নিষিদ্ধ ঘোষিত হাইড্রোলিক হর্ণ। শুধু তাই না মাইক, লাউড স্পিকার, ইট ও পাথর ভাঙ্গার মেশিন, জেনারেটর ইত্যাদি থেকে নির্গত শব্দ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

বর্তমান সময়ে বায়ুদূষণ-পানিদূষণ রোধ এবং বনায়নের মাধ্যমে সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতে আলোচনা থাকলেও শব্দদূষণ সম্পর্কে আলোচনা একেবারেই সীমিত। শব্দদূষণের কারণে যে মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপ অনুযায়ী মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি কমিয়ে দিয়েছে। উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের করোনারি আর্টারি ডিজিজ তৈরি করছে। শব্দ দূষণের কারণে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, মাথাব্যথা, খিটখিটে মেজাজ, পেপটিক আলসার হতে পারে। রাতে ঘুমানোর ক্ষেত্রেও যদি শব্দ দূষণ হয় তাহলে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেবে।

শব্দ দূষণের কারণে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যানবাহনের হর্ণ, দ্রুতগতির শব্দ এরসঙ্গে আছে আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত মেশিনের শব্দ, যা স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝূঁকিপূর্ণ। যেমন ৩০-৩৫ ডেসিবেলের উপর শব্দমাত্রায় নার্ভাসনেস ও ঘুমের ব্যাঘাত, ৬৫ ডেসিবেলের অধিক মাত্রায় হৃদরোগ, ৯০ ডেসিবেলের উপর হলে আলসার ও স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তন এবং ১২০ ডেসিবেলের অধিক শব্দমাত্রায় শ্রবণযন্ত্রে ব্যাথা এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণ শক্তি লোপ পেতে পারে। রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য শব্দদূষণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এর কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জন্ম গ্রহণ করতে পারে। এমনকি তিন বছর বয়সের নিচে কোন শিশুর কানে যদি খুব কাছ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ আসে তাহলে তার শ্রবণ ক্ষমতা চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।

মূলত সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা না থাকায় ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে না বুঝে পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। জীবিকার সন্ধানে মানুষ ঘর থেকে বের হয়। জীবন বাঁচানোর তাগিদে জীবিকার অন্বেষণে ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে সুস্থতার বিকল্প নেই একথা ভূলে গেলে বেঁচে থাকার স্বার্থকতা থাকেনা। অন্যের ক্ষতির তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া যানচালক যে হর্ণ ব্যবহার করছেন তা প্রতিনিয়ত তাঁরই ক্ষতি করে চলেছে। সেই ক্ষতির শিকার প্রথমত তিনিই হচ্ছেন, এই বোধ অর্থ্যাৎ চেতনা তৈরিতে কাজ করতে হবে সরকারি-বেসরকারী দপ্তরের সাথে সুশীল সমাজকেও। শব্দের মাত্রাকে নিয়মের গন্ডিতে বেঁধে রাখতে হলে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে ঘরে ঘরে। সর্বক্ষেত্রে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর এলাকায় পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। পিআইডি ফিচার/ লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিস, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা।