তবু রমজানে তেল নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোক্তা

7
Spread the love

ঢাকা অফিস।।

প্রতি বছর রোজা শুরুর দিন কয়েক আগেই ইফতার-সেহরির প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনাকাটা করে থাকেন মালিবাগের বাসিন্দা আলফাজ উদ্দিন। এ বছরও দিন চার বাকি থাকতেই তিনি বাজার থেকে চিনি, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, বেসন, খেসারির ডালসহ রমজাননির্ভর আরও কিছু পণ্য কিনলেন।

প্রতিবারের এসব পণ্য পরিমাণে দুই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত কেনা হলেও এবার সবই কিনলেন এক কেজি করে। কারণ সবকিছুরই দাম চড়া।

বিপত্তি দেখা দিল ভোজ্যতেল কিনতে গিয়ে। তিনি দোকানিকে এক লিটার সয়াবিন তেলের দুটি বোতল দিতে বললেন। হাতে পাওয়ার পর লেবেলে দাম দেখে তিনি অবাক। সরকার এই ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা কমালেও এখানে এক লিটার বোতলের দাম সেই আগের ১৬৮ টাকাই।

আলফাজ কারণ জানতে চাইলে দোকানি জানালেন, নতুন দামের পণ্য আসেনি। আগে বেশি দামে কেনা পণ্যই আছে তার কাছে।

উপায় না দেখে আরেক দোকানে গেলেন এই ভদ্রলোক। কিন্তু সেখানে নতুন দামে পেলেন শুধু পাঁচ লিটারের বোতল। এক লিটারের বোতল নেই। বাধ্য হয়ে তিনি পকেট খালি করে পাঁচ লিটার তেলই কিনলেন।

রাজধানীর প্রায় সব কাঁচাবাজার কিংবা গলির মোড়ের দোকানে একই অবস্থা। কোথাও এক লিটার পাওয়া গেলে মেলে না পাঁচ লিটারের বোতল, আবার কোথাও শুধু দুই লিটার বোতলজাত সয়াবিনই রাখা হয়েছে, যা বিক্রি করা হচ্ছে আগের নির্ধারিত দামে। একই অবস্থা পাম তেলেও। লিটারে দাম তিন টাকা কমানো হলেও সব জায়গায় মেলে না পাম তেল। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, তা আগের বাড়তি দামে কেনা উল্লেখ করে বিক্রি হচ্ছে প্রতিলিটার ১৪৫ টাকা বা স্থানভেদে তারও বেশি দামে। অথচ পাম তেলের সরকার নির্ধারিত দাম হলো ১৩০ টাকা।

এদিকে গত বছর রমজানে যে বোতলজাত সয়াবিন তেল কেনা হয়েছে ১৩০ টাকায়, এবার তার ওপর ৩০ শতাংশ ভ্যাট কমানোর পরও সরকার নির্ধারিত দাম ধরা হয়েছে ১৬০ টাকা। এই দামেও তেল কেনার সুযোগ সবখানে হচ্ছে না।

অর্থাৎ ভোজ্যতেল নিয়ে ভোক্তার দুশ্চিন্তা শেষ হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দরবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশে গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে লাগামহীন বেড়েছে দাম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ভোজ্যতেলের আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রি পর্যায়ের ৩৫ শতাংশ ভ্যাট থেকে ৩০ শতাংশই প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে পণ্যটির লিটারপ্রতি দামও সরকার বেঁধে দেয়।

আমদানিকারক, পরিশোধন ও বিপণনকারীরাও সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকার নির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেয়। তারপরও বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট কাটছে না। ভোক্তারা মনে করছেন, সরকার যদি এখন শক্ত হাতে বাজার মনিটরিং বজায় না রাখে এবং দায়ীদের চিহ্নিত করতে আইনানুগ ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে রমজানেও ভোজ্যতেলের তেলেসমাতি থামবে না।

সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, কোনো পণ্যের দাম তখনই সহনীয় থাকে কিংবা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়, যখন পণ্যটির পর্যাপ্ত সরবরাহ সর্বত্র বজায় থাকে। কিন্তু বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকটই এখনও দূর হয়নি।

ভোজ্যতেলে সরবরাহ সংকট ও দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করতে রাজি হননি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, কোথাও সরবরাহ সংকট আছে, কোথায় দাম বাড়তি। পণ্যটির সরবরাহ বাড়াতে সরকার ভ্যাট কমিয়েছে, দামও নির্ধারণ কিরে দিয়েছে। পাশাপাশি সর্বত্র মনিটরিং জোরদার করেছে। এসবের প্রভাবে বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি দামও কমে এসেছে। বাজারে এখন সরকার নির্ধারিত দামেই ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে। তবে কোথাও কোথাও একটু বেশি হতে পারে, তার কারণ হলো আগের বাড়তি দামে কেনা মাল অনেকের স্টকে রয়ে গেছে, সেগুলো ফুরানোর আগে হয়তো অনেকে মাল ওঠাতে চাইছে না। তবে আমরা বেশ সতর্ক আছি।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে চাহিদার তুলনায় ভোজ্যতেলের বেশি মজুত আছে। সরবরাহ চেইনও স্বাভাবিক। সারা দেশে সরকারের জোরদার মনিটরিং অব্যাহত আছে। তাই রমজানে ভোজ্যতেল নিয়ে কারও দুশ্চিন্তার কোনো কারণ দেখছি না।’

একই কথা জানিয়েছেন ভোজ্যতেলের আমদানিকারক, পরিশোধন ও বিপণনকারী এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরাও।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও টি কে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার জামিল বলেন, ‘দেশে এখন যে তেল চলে এসেছে, সেগুলো আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ডিউটি ও ভ্যাট আগেই পরিশোধ করা হয়েছে। সরকারের উচিত তা ফিরিয়ে দেয়া। তাহলে আমরাও লোকসানের হাত থেকে বেঁচে যাই।’

মৌলভীবাজার ভোজ্যতেল পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘ভোজ্যতেল নিয়ে এত বেশি কথা হচ্ছে, শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। দুশ্চিন্তা করবেন না, রমজানকে সামনে রেখে দেশে মজুত ও প্রবেশাধীন তেল দিয়ে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হবে।’

ব্যবসায়ীদের অ্যাপেক্স বডি এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আশ্বস্ত করে বলেন, ভোজ্যতেলের সরবরাহ পুরো রমজান পর্যন্ত ঠিক থাকবে। মিলমালিকরা ইতিমধ্যে সেটি নিশ্চিত করেছেন। তবে সেটি কতটা বজায় থাকল, সরকারের পাশাপাশি এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে তার মনিটরিং করা হবে। কেউ কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হলে এফবিসিসিআই সরকারকে সাধুবাদ জানাবে।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়িয়ে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সে দর অনুযায়ী বাজারে এতদিন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের সরকার নির্ধারিত দাম ছিল ১৬৮ টাকা এবং পাঁচ লিটার সয়াবিনের দাম ৭৯৫ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের দাম ১৪৩ টাকা।

৩০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের পর সেই দাম কমে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৬০ টাকা, পাঁচ লিটারের ৭৬০ টাকা এবং প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৩৬ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট তুলে নেয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাসও করি, দেরিতে হলেও বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এর জন্য সরকারের অব্যাহত নজরদারি এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।’