ইউক্রেনে কেন নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করেনি ন্যাটো?

5

খুলনাঞ্চল ডেস্ক।।

ইউক্রেন ইস্যুতে জোটের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার জন্য শুক্রবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে মিলিত হয়েছেন ন্যাটোর ৩০টি সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পর এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ইউক্রেনের আকাশসীমায় নো ফ্লাই জোন ঘোষণার কিয়েভের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে ন্যাটো।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ন্যাটো মূলত নো ফ্লাই জোন নিয়ে ভাবছেন না কয়েকটি কারণে। প্রথমত, ইউক্রেন কিংবা রাশিয়া কেউই ন্যাটোভুক্ত দেশ নয়। এছাড়া নো ফ্লাই জোন ঘোষণার আরেক অর্থ হলো, রুশ যুদ্ধবিমানে ন্যাটোর হামলা। যা করা হলে পরমাণু শক্তিধর রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলে আরও বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটতে পারে।

খুব সহসাই ইউক্রেনের বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দেশটির মূল অঞ্চলগুলো এখনও ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে রাজধানী কিয়েভ অভিমুখে রুশ বাহিনীর ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ বহর কয়েকদিন ধরে আটকে আছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকা অবশ্য এরইমধ্যে দখলে নিয়েছে রুশ বাহিনী। স্থানীয় সময় শুক্রবার সকালে তারা জাপোরিঝিয়া শহরে ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয়।

নো ফ্লাই জোন নিয়ে ইউক্রেনের জোরালো অনুরোধেও মন গলেনি ন্যাটো মিত্রদের। সাবেক সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত দেশটিতে নো ফ্লাই জোন ঘোষণার সম্ভাবনা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে ন্যাটো। অর্থাৎ, ইউক্রেনের আকাশে রুশ যুদ্ধবিমানকে প্রতিহত করবে না ন্যাটো।

প্রকৃতপক্ষে এই সংঘাতে সরাসরি জড়াতে চায় না যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা এই সামরিক জোট। বস্তুত বেসামরিকদের প্রাণহানি ঘটে, এমন হামলার বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পদক্ষেপের প্রতি আগ্রহ নেই তাদের।

শুক্রবার ব্রাসেলসে ন্যাটোর বৈঠক শেষে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন জোটের মহাসচিব জেনস স্টোলটেনবার্গ। এ সময় তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ‘আমরা এই দ্বন্দ্বের অংশ নই। যুদ্ধটা ভয়ানক। এটাও সত্য যে আরও ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমরা যদি এটি (নো ফ্লাই জোন) করি তাহলে যুদ্ধ গোটা ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আরও অনেক দেশ এতে আক্রান্ত হতে পারে। আমাদের মিত্ররা এ ব্যাপারে একমত যে, ইউক্রেনের আকাশসীমায় ন্যাটোর উড়োজাহাজ চলবে না। দেশটির মাটিতেও কোনও অপারেশন চালাবে না ন্যাটো। আমাদের এই জোট হলো প্রতিরক্ষামূলক। আমরা কোনও যুদ্ধ চাই না। তবে যুদ্ধ আমাদের দরজায় এলে আমরা তৈরি আছি।’

ন্যাটো কী?

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ৩০ জাতির সামরিক জোট ন্যাটো। এই ৩০টি দেশের ২৮টি ইউরোপের, বাকি দুইটি হচ্ছে উত্তর আমেরিকার দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। ন্যাটোর পূর্ণ রূপ হচ্ছে দ্য নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশন। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট। সংক্ষেপে এটিকে ন্যাটো বলা হয়।

১৯৪৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের যে কোনও হামলা প্রতিরোধের জন্য গঠন করা হয় ন্যাটো। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ যখন থেমে গেলো, ন্যাটো জোটের উদ্দেশ্যও তখন কিছুটা বদলে যায়। ইউরোপে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য নতুন অনেক দেশকে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশ ন্যাটোতে যোগ দেয়, যা পুতিনের অস্বস্তির কারণ।

অন্য অনেক দেশের সঙ্গেও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। এই পর্যায়ে ন্যাটো কোনও কোনও দেশের যুদ্ধ-বিগ্রহ বা গণহত্যা থামাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। যেমন বলকান যুদ্ধ।

ন্যাটোকে শুধু একটি সামরিক প্রতিরক্ষা জোট ভাবলে ভুল করা হবে। এটি আসলে তার চেয়ে বেশি কিছু। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো বাকী বিশ্বকে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, তার অন্যতম ন্যাটো। এটিকে আটলান্টিকের দুই তীরের দেশগুলোর অভিন্ন মূল্যবোধ ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।

ন্যাটোর সদস্য হওয়ার অর্থ কী?

পশ্চিমা এই সামরিক জোটের সদস্য হওয়ার অর্থ হলো জোটের স্বার্থ রক্ষায় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক নিয়মিত আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখা। এর মধ্যে সাইবার যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশলগত পদক্ষেপ থেকে শুরু করে অন্যান্য সদস্যের সুরক্ষার জন্য ন্যাটোর সীমানার মধ্যে সেনা পাঠানোর মতো বিষয়গুলোও রয়েছে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে বর্তমান সংকটেও ন্যাটোর সীমানায় সেনা পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে।

জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বছর তাদের জিডিপির দুই শতাংশ প্রতিরক্ষার জন্য ব্যয় করার কথা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব কম সংখ্যক সদস্যই এ নিয়ম মেনে চলেছে।

সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো চুক্তির পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এক মিত্র দেশের বিরুদ্ধে হামলা সব মিত্রদের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হবে।’ এই অনুচ্ছেদটি এখন পর্যন্ত মাত্র একবারই কার্যকর হয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় একযোগে প্রতিক্রিয়া জানায় ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো।

ন্যাটোর অবশ্য পঞ্চম অনুচ্ছেদ ছাড়াও সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ হামলার ঘটনায় তেমন পদক্ষেপই নিয়েছে তারা।

নো ফ্লাই জোন কী?

নো ফ্লাই জোন হচ্ছে এমন এলাকা যার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট কোনও বিমান কোনওভাবেই উড্ডয়ন করতে পারে না। ইউক্রেন তার দেশে যে নো ফ্লাই জোন দাবি করছে তার অর্থ দাঁড়ায়, দেশটির আকাশসীমায় রুশ যুদ্ধবিমানকে প্রতিহত করা। অর্থাৎ, রুশ যুদ্ধবিমানে ন্যাটোর হামলা।

ইতোপূর্বে বসনিয়া ও লিবিয়াসহ জোটের সদস্য নয় এমন দেশগুলোতে ন্যাটোর নো ফ্লাই জোন আরোপের নজির রয়েছে। তবে এখন প্রতিপক্ষ রাশিয়ার মতো পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়ায় মিত্র ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও এখন নো ফ্লাই জোনের প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছে ন্যাটো।

নো ফ্লাই জোনে ন্যাটোর আপত্তি কেন?

ইউক্রেন বা রাশিয়া কেউ ন্যাটোর সদস্য নয়। পুতিন স্পষ্টতই এই জোটকে তার কর্তৃত্বের জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দিতে তিনি ন্যাটোর বিস্তৃতি এবং ইউক্রেনের এই জোটে যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন।

রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধকে সমর্থন জানালেও ন্যাটো এমন কিছু করতে প্রস্তুত নয় যা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কেননা এ ধরনের সংঘাত পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

ন্যাটোকে কেন হুমকি মনে করে রাশিয়া?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়াকে তার দেশের জন্য ‘২০ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলে মনে করেন। তার সবচেয়ে বড় আপত্তি, পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলো এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তাদেরও নিজেদের জোটে অন্তর্ভুক্ত করেছে ন্যাটো। পুতিন মনে করেন, একসময় মস্কোর প্রভাব বলয়ে থাকা দেশগুলোতে ন্যাটোর সম্প্রসারণের ফলে এই জোট রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেটি মস্কোর জন্য উদ্বেগের। সিএনএন অবলম্বনে।