মাওলানা ফারুক এখন ‘রস কাকা’

0
Spread the love

যশোর অফিস।।

একাধারে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ইউনিয়নের বিবাহ রেজিস্ট্রার (কাজি)তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি এখন ‘রস কাকা’ নামেই পরিচিতি লাভ করেছেন। আসল নাম কাজি মাওলানা ফারুক হোসেন (৫৯)

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা ইউনিয়নের বহরমপুর কাউন্সিলপাড়ার বাসিন্দা তিনি। স্থানীয় লোকজন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা জানান ফারুক হোসেনের নানা ভালো কাজের কথা।

প্রতিদিন সকালে তিনি বের হন আগের দিন কাটা খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করতে। একটা বাইসাইকেলে খালি কলসি নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের গাছগুলো থেকে নিজ হাতে নামিয়ে আনেন রস। আর এই রস যেন নিরাপদে সবাই পান করতে পারেন, সে জন্য তিনি গাছের কাটা অংশ থেকে হাড়ির মুখ পর্যন্ত ঢেকে দেন নেট দিয়ে। যাতে পাখি, কাঠবিড়ালি কিংবা বাদুড় সেখানে মুখ দিতে না পারে।

এরপর রসের হাড়িগুলো নিয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে। রস বাড়িতে পৌঁছানোর পর তার মেজো ছেলে মাহবুব হেলাল (এবার এসএসসি পাস করেছে) হ্যান্ডমাইকে বাড়ির সামনে রাস্তায় মাইকিং করে জানায়, যেসব ছেলেমেয়ে রস খাবে, তাড়াতাড়ি গ্লাস-মগ নিয়ে আসতে হবে। মাইকিং শুনে পাড়ার ২০-২৫ শিশু কেউ মগ, কেউ গ্লাস, কেউবা বোতল নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হয়। এরপর সবাইকে রস খেতে দেন ফারুক হোসেন। কেউ কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে পান করে, কেউবা বাড়িতে নিয়ে যায়। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এমন কাজের জন্য ভালোবেসে ফারুক হোসেনকে ‘রস কাকা’ বলে ডাকেন গ্রামের সবাই।

যশোর সদরের ফুলবাড়িয়া এলাকার স্কুলছাত্রী বিন্তি এসেছিল মগ নিয়ে। সে জানায়, মামার বাড়ি এসেছে বেড়াতে। ফারুক হোসেনের বাড়ির পাশেই তার মামার বাড়ি। সকালে মাইকিং শুনে বছরের প্রথম রস নিতে এসেছে সে। রস পান করে অনেক খুশি বিন্তি। তেমনই একই গ্রামের শাকিল, সবুজসহ অন্যরা নিয়মিত আসে ‘রস কাকা’বাড়িতে, পান করে খেজুরের রস।

বহরমপুর এলাকার বাসিন্দা আলী আহমেদ বলেন, মাওলানা ফারুক হোসেন অত্যন্ত ভদ্র মানুষ সজ্জন ব্যক্তি। গ্রামের লোকজনকে খেজুরের রস পান করানো ছাড়াও তিনি সমাজসেবামূলক নানা কাজ করে থাকেন। এই এলাকার মানুষের সুবিধার্থে তিনি গোরস্তানের জন্য জমি দান করেছেন। লোকজন যেন তাল খেতে পারেন, সে জন্য রাস্তার পাশে প্রায় আট হাজার তালের চারা লাগিয়েছেন। বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদের জমিতে লাগিয়েছেন নানা ধরনের ফুল ফলের গাছ। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ফাঁকা স্থানে ফলদ-বনজ বৃক্ষ লাগিয়েছেন। গ্রামের রাস্তা ভেঙে গেলে নিজেই কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে মাটি ফেলে তা সংস্কার করেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাওলানা ফারুককে এক নামেই এই এলাকাসহ আশপাশের মানুষজন চেনেন। তিনি শিশুদের পাশাপাশি বয়স্কদেরও রস পান করান। বহরমপুর বাজারে এমন কেউ বলতে পারবে না, যে কি না তার রস পান করেননি। কারও বাড়ি আত্মীয়-স্বজন এলে তিনি তাদের বাড়িতেও রস পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। জন্য তিনি সবার কাছে ‘রস কাকা’ নামে পরিচিত।

রস কাকা’ভাষ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলে দক্ষ গাছির অভাবে খেজুর গাছ কাটা হয় না। তা ছাড়া পরিশ্রম বেশি হওয়ায় মানুষ গাছ কাটতেও আগ্রহী নন।

বছর পাঁচেক আগে তিনি দেখেন এলাকার বেশকিছু গাছ কাটার অভাবে এমনিতেই পড়ে রয়েছে। তখন নিজে টাকা খরচ করে গাছগুলো পরিষ্কার করে তা কাটার উপযোগী করেন। সেই থেকে চলছে তার রস খাওয়ানোর কাজ।

কাজি মাওলানা ফারুক হোসেন বলেন, অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই গাছ কাটি, রস নামিয়ে আনি। তারপর মাইকিং করে এলাকার ছেলে-বুড়ো সবাইকে আহ্বান করি রস পান করার জন্য। কখনও কখনও বোতলে ভর্তি করে সেই রস পাড়া-মহল্লার লোকজনের বাড়িতে পৌঁছে দিই।

খেজুর গাছ কাটা, গাছ থেকে রস আহরণ করা- খুবই কষ্টের কাজ। কিন্তু যখন ছেলেমেয়েরা সেই রস পান করে আনন্দ পায়, তা দেখে আমি খুব খুশি হই। সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। বাজারে যখন রস নিয়ে যাই, মানুষজন খেয়ে বলে-৫-বছর পর রস খেলাম- আমার আনন্দে বুক ভরে যায়।

তিনি বলেন, আজ রস হয়েছে ভাড়; তার সবটুকুই বাড়িতে আসা ছেলেমেয়ে আর বাজারের মানুষজন পান করেছে। এখন এই অঞ্চলে তেমন রস মেলে না। ছোট ভাড়ের দাম দেড়শ’ টাকা আর বড় ভাড় দুইশ’ টাকা। অনেকে কিনে খেতে পারেন না। আমি তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

ফারুক হোসেন আরও জানান, অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে তিনি খেজুর গাছ কাটা শুরু করেন। খলশী আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক মাওলানা ফারুক হোসেন ৩১ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। মসজিদের ইমামতি করছেন ৩৩ বছর এবং বিবাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ২১ বছর ধরে।

দুই ছেলে আর এক মেয়ের গর্বিত বাবা ফারুক হোসেন। বড় ছেলে নাজমুস সাকিব ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে (চট্টগ্রাম) আল কোরআন হাদিস এবং দাওরাহ বিষয়ে অনার্স (তৃতীয় বর্ষ) করছেন। মেজো ছেলে মাহবুব হেলাল চলতি বছর এসএসসি পাস করেছে এবং একমাত্র মেয়ে উম্মে হাবিবা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। তারা প্রত্যেকেই বাবার এসব কাজে সহায়তা করে।

বহরমপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য (৭, নম্বর ওয়ার্ড) শাহিনা পারভীন বলেন, মাওলানা ফারুক আমাকে চাচি বলে ডাকেন। তিনি একজন গুণী মানুষ। একাধারে তিনি শিক্ষক, ইমাম, বিয়ে-শাদি পড়ান, একজন হাজি মানুষ। এলাকার লোকজন ছাড়াও স্কুল, মাদ্রাসারা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বাজারের লোকজন সবাইকেই শীত মৌসুমে রস পান করান। বিনে পয়সায় মানুষকে এমন সেবা দেওয়ার লোকের খুব অভাব। জন্য সবাই ভালোবেসে তাকে ‘রস কাকা’ বলে ডাকেন। আমি আশা করি, তার এই কাজ দেখে আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হবেন।